অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা
ভূমিকা:
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”
– নারী: কাজী নজরুল ইসলাম
ধরিত্রীসম প্রেয়সীময় যে মানবী সেই তো নারী। সৃষ্টির শুরু থেকে সে পুরুষকে সান্নিধ্য দিয়েছে, দিয়েছে প্রেরণা, দূর করেছে ক্লান্তি অবসাদ। নারী তো শুধু পুরুষের সঙ্গীই নয়, সে কখনো জননী, কখনো বীরাঙ্গনা। সমাজের মঙ্গলে, দেশের উন্নয়নে, তথা মানব সভ্যতাকে বিকশিত করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো বা পরোক্ষভাবে নারীরা দেশ গড়ার কাজে ব্যাপৃত। বস্তুত, বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে নারীর ভূমিকা স্পষ্ট। নারীর উদ্দীপনাতেই মানবজীবনে সমাজ ও সভ্যতার আদি ভিত রচিত হয়েছিল। কালক্রমে নারী ভূষিত হলো পাপের প্রতীক হিসেবে, শৃঙ্খলিত হলো অসূর্য স্পর্শা রূপে, গৃহের চার দেয়ালে বন্দি হলো অবরোধবাসিনী হিসেবে। কিন্তু মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ, উন্নতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে নারীর অবদান শরের মতোই সমান তাৎপর্যপূর্ণ । নারীর বিকাশের অর্থ সভ্যতার বিকাশ। তাই পরিবার, সমাজ, দেশ তথা জাতির বিকাশের জন্য স্ত্রীশিক্ষার মাধ্যমে নারীর শৃঙ্খলমুক্তি তথা নারীর ভাগ্যোন্নয়ন অপরিহার্য ।
বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও নারী:
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সমাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই নারী উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। কোনো বিশেষ জাতি বা সমাজ নয়, গোটা বিশ্বের উন্নয়নের জন্যই উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে নারীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে নারীর মৌলিক অধিকার লাভের বিষয়টি আত্ব দিতে হবে সর্বামে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বকৃতি দেখা এবং ১৯৭৫-১৯৮৫ সালকে বিশ্ব নারী দশক হিসেবে ঘোষণা দেয়। বিশ্ব নারী দশক পালনের উদ্দেশ্য ছিল নারীর উন্নয়ন, পরিবার ও সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি ।
আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা:
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণই অরুত্বপূর্ণ। আমাদের অর্থনীতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, এদেশের অর্থনীতিতে নারীর যষ্টে অবদান রয়েছে। আমাদের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীরা বিশেষ অবদান রাখছে। নিচে আমাদের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো
১. কৃষিক্ষেত্রে: বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনীতি কৃষির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। কৃষিক্ষেত্রে নারীর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী-সন্তানের কৃষিকাজে সমতালে সাহায্য করে যাচ্ছে আমবাংলা কৃষকবন্ধুরা। ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে পুরুষ বেশি জড়িত। কিন্তু প্রক্রিয়াজাতকরণের বিশাল অংশটি নারীই সম্পাদন করে। তাছাড়া বাড়ির আশেপাশে পতিত জমিতে শাকসবজি চাষ করে তারা পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে।
২. পোশাক শিল্পে নারী: বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত হলো পোশাক শিল্প। বিদেশে পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রতি বছর অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এই পোশাক শিল্পের প্রধান চালিকা শক্তি হলো নারী। বর্তমানে। পোশাক শিল্পে প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিক কাজ করে যার শতকরা ৮৫ ভাগই হলো নারী।
৩. ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে নারী: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প। কুটিরশিল্পের মধ্যে রয়েছে তাঁতশিল্প, কারুশিল্প, বয়নশিল্প প্রভৃতি। তাঁতশিল্পে নারীরাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। নারীরা ঘরে বসে। তৈরি করে বাঁশ-বেতের বিভিন্ন আসবাব ও খেলনা। এছাড়া নকশিকাঁথা, শীতলপাটি প্রভৃতি ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলোও তৈরি করছে নারীর।
৪. ব্যবসায়ক্ষেত্রে: আমাদের দেশের নারীরা চাকরির পাশাপাশি ব্যবসায়ের সাথেও নিজেদের যুক্ত করছে। ইতোমধ্যে অনেক নারীই সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ৩৫ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা।
৫. চা-শিল্পে: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো চা-শিল্প। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে চা উৎপন্ন হয় এবং চা থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। বাংলাদেশের চা-শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকদের অধিকাংশই হলো নারী।
৬. চিকিৎসাক্ষেত্রে: বাংলাদেশের অনেক নারীই এখন চিকিৎসা পেশায় আসছে। তাদের পছন্দের তালিকায় প্রথম অবস্থানেই রয়েছে চিকিৎসক পেশা। চিকিৎসা পেশায় নারীর অংশগ্রহণে একদিকে যেমন দেশীয় অর্থনীতিতে নতুন সূচক যুক্ত হয়েছে, অন্যদিকে চিকিৎসাক্ষেত্রেও অনেক উন্নতি হয়েছে।
৭. শিক্ষাক্ষেত্রে: শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আজ তারা শিক্ষিত হয়ে শিক্ষকতা পেশাকে গ্রহণ করছে। প্রতি বছরই বিপুলসংখ্যক নারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হয়। এছাড়া মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় নারীরা বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং শিক্ষা উভয়ক্ষেত্রেই নারীর এ ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
৮. প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে: প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করছে এবং অর্থনীতিতে যোগ করছে এক নতুন মাত্রা। আমাদের দেশের অনেক নারী দেশের বাইরে কাজ করে। ১৯৯১ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, তখন বছরে দুই হাজার নারীকর্মী বিদেশে গেছে। বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক বিদেশে কাজ করছে। সরকারের হিসেব অনুযায়ী মোট অভিবাসী শ্রমিকের ১৩ শতাংশেরও বেশি নারী। নারী শ্রমিকরা আয়ের ৭০ শতাংশেরও বেশি দেশে পাঠায়।
৯. অন্যান্য: এসব ক্ষেত্র ছাড়াও হিমায়িত চিংড়ি, চলচ্চিত্র নির্মাণ, সংবাদ পাঠ, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, ট্রেন চালনা, চামড়া প্রভৃতি পন্য। উৎপাদনের সঙ্গে নারী সরাসরি জড়িত। এসব শিল্পের প্রধান কাজগুলো করে নারীরাই।
ফলাফল :
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহন একদিকে যেমন দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে অন্যদিকে তেমনি নারীকেও গবলম্বী করে গড়ে তুলছে। আমাদের দেশের অনেক নারীই এখন পুরুষের আয়ের উপর নির্ভশীল নয়। তাই নারীর ভূমিকা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সামাব নয়, এর ফলাফল আরও সুদূরপ্রসারী।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীসমাজের ভূমিকা বৃদ্ধি করার উপায়:
নারীর অংশগ্রহণ ব্যতীত আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে কখনোই সম্ভব নয় তা আমরা উপরিউক্ত আলোচনা থেকে খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারি। তাই এ ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। এজন্য নিম্নোক্ত উপায়সমূহ অবলম্বন করা যেতে পারে—
১.নারীসমাজকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে এবং কুসংস্কারমুক্ত করতে হবে।
২. ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করতে হবে।
৩. কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
৪. অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক প্রতিটি শাখায় উৎপাদনকার্যে নারীদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
৫. পূর্ণ নিরাপত্তা কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে।
৬. শ্রমের যথার্থ মূল্য নিতে হবে।
উপসংহার:
কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সে দেশের প্রতিটি নাগরিকের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। সবার মিলিত শক্তিই দেশের আয়নকে ভুরান্বিত করে। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই হলো নারী। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ পূর্ণ আমাদের নারীরা এখন অতীতের তুলনায় নানামুখী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। ফলে আমাদের অর্থনীতি অনেকাংশে। = সমৃদ্ধ হচ্ছে। এ দেশের অর্থনীতি সেদিনই পুরোপুরি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে যেদিন নারী-পুরুষ সমানতালে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাবে। তাই নারীদের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আরো দেখুন :
Paragraph : Arsenic Pollution in Bangladesh
Paragraph : Brain Drain
Paragraph : Food Adulteration
রচনা : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা