বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
ভূমিকা:
কোথায় ফলে সোনার ফসল
সোনার কমল ফোটেরে,
সে আমাদের বাংলাদেশ
আমাদেরই বাংলা রে।
বাংলাদেশের এই প্রাকৃতিক চিত্র আবেগে উচ্ছ্বসিত কিন্তু কল্পিত নয়। অত্যুক্তি না। সুন্দর এই বাংলাদেশে প্রকৃতির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে যেন কত নীল আকাশের নীলা। কত মোহ, কত ঋতু-ঋতুবৈচিত্র্য রামধনু। কত ছায়াপথের আলো-ছাঁয়া। সূর্যাস্তের রক্তরাগ পৃথিবী প্রকৃতির এ এক লীলাগৃহ। ষড়ঋতুর রঙ্গশালা। এই বাংলাদেশ নিপুণ শিল্পীর আঁকা এ যেন স্বপ্নীল ক্যানভাস। সত্যি বলতে, নদ-নদী বিধৌত, শস্য-শ্যামল, গাছ-গাছালি আর ঘন জঙ্গলে আবৃত, প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরপুর বাংলাদেশের মতো দেশ আর আছে কি। ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময়তায় বাংলাদেশকে একটি অপূর্ব শ্রী, শোভা, সৌন্দর্য, স্বাতন্ত্র্য ও মহিমা দিয়েছে। বাংলার এই অপরূপ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েছে বৃটিশ, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, বর্গী ইত্যাদি। চর্যাপদের সেই বিখ্যাত প্রবাদের মতো ” আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।” ফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্য যেমন আকৃষ্ট করে কীট-পতঙ্গকে তেমনি বাংলার এই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার কাল হয়েছে।
সৌন্দর্যের পালাবদল:
বাংলাদেশ ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ। এখানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রকৃতি তরলে তাণ্ডবে, কঠোরে- কোমলে অপরূপ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত -এই ছয়টি ঋতু পালাক্রমে আসে সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে গ্রীষ্ম হচ্ছে ব্রাহ্মণ। কারণ গ্রীষ্ম প্রকৃতিতে আসে ব্রাহ্মণের মতোই ফলাহার সাজিয়ে নিজের ঐশ্বর্যকে জানান দিয়ে। বর্ষাকে তিনি বলেছেন ক্ষত্রিয়; কারণ মেঘের রথে চড়ে দিগ্বিজয়ী বীরের মতো সশব্দে উল্লাসে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। শীতকাল হচ্ছে বৈশ্য। কারণ নতুন ফসলে ধরণীর ডালা পূর্ণকরে তার মুখর আবির্ভাব। তাঁর মতে শরৎ ও হেমন্ত হচ্ছে শুদ্র। শূদ্র বলে এরা ক্ষুদ্র নয়, বরং বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অধীশ্বর। বসন্তে তো মধু আর মাধবের বিপুল সমাহার। স্বভাবের বিচারে ছয়টি ঋতু হলেও একথাও অনস্বীকার্য যে, এখানে সব ঋতুতেই সবুজের ছড়াছড়ি। চোখ মেললেই দেখা যায় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত রাশি রাশি সবুজ দেশটিকে আদ্যোপান্ত ছেয়ে ফেলেছে। বিচিত্র ঋতু বিচিত্র সাজে সাজায় এই বাংলাদেশকে। প্রতিটি ঋতুতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য স্বাতন্ত্র্য—
গ্রীষ্ম:
পাকা ফলের মৌ মৌ গন্ধে ভরপুর থাকে সে তু তা হলো গ্রীষ্ম। এ ঋতুতেই অবস্থান মধুমাস জৈষ্ঠের প্রখরতার এক সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় এই সময়ে। বয়স্করা ঘুমালে সেই দুপুরে শুরু হয় শিশুদের আনন্দের ধুম। গাছের ডালে ডালে ঘুরে গাছপাকা আম খাওয়া, এঁটেল মাটি দিয়ে মার্বেল তৈরি করে খেলা, অথবা নাড়ার আগুনে পুড়িয়ে শিম খেয়ে মুখ কালো করা কিংবা পাকা জামের রসে মুখ নীল করে পুকুরে ডুব পাড়া এ সবই শোভা পায় গ্রীষ্ম ঋতুতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ঋতুর আগমনকে বন্দনা করেছেন এভাবে—
বর্ষা:
গ্রীস্মের খরতাপে ধরণী যখন রুক্ষ, মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। চাতক পাখি চেয়ে থাকে এক ফোটা জলের জন্য মেঘের পানে। তখন শান্তির বারতা নিয়ে আসে বর্ষা।
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়িয়ে
ঊর্ধ্ব মুখে নর-নারী ।
বর্ষায় খাল-বিল, নদী-নালা পানিতে ভরে যায়। নদীর দুকূল প্লাবিত হয়ে চারদিক জলে একাকার হয়ে যায়। নদীগুলোতে জাগে দুরন্ত ঢেউ। সবুজে ঘেরা গ্রামগুলো বর্ষার ভরা জলের মধ্যে দ্বীপের মতো ভাসতে থাকে। ছোট ডিঙ্গি নৌকা কিংবা ভেলায় চড়ে মানুষ পারাপার হয়। পাটগাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে মাথা তুলে। ধানগাছ শীষ জাগিয়ে আকণ্ঠ ডুবে থাকে জলে। বিলে বিলে ফোটে শাপলা, ফোটে পদ্মফুল। বনে বনে ফোটে কেয়া আর কদম। এসময় সারাক্ষণ আকাশ থাকে মেঘাচ্ছন্ন। আকাশ থেকে নামে বৃষ্টি। বৃষ্টির অবিরল অবিচ্ছিন্ন ধারায় প্রকৃতি স্নাত হয় ।
আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর
কালিমাখা মেঘ ওপারে আমার খনিয়ে দেখ চাহিরে
শরৎ:
আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে আসে । সোনালি রোদে ছেয়ে যায় ধরা। কৃষকের ঘরে ঘরে ধান কাটার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। শিশিরভেজা দূর্বাঘাসে সকালের রোদ লেগে মুক্তোদানার মতো আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। বনে ফোটা কামিনী, কেয়ার গে মৌ মৌ করে চারিদিক। শরতে নদীর জন্য কমতে থাকে মৌসুম আসে জেলের। কূলে রক্ষিত অর্ধ জ্বলন্ত নৌকা এবং তার উপর বসা মাছরাঙ্গা পাখি অপূর্ব সুখমার সৃষ্টি করে। নদীর দুই তীরের সাদা সাদা কাশবন শরতের বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরো বাড়ায়। কবির ভাষায়-
শরতের পূর্ণিমারার এবং শরৎ শব্দীর বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকিংবদন্তির মতো। শরতের জোছনা রাতের স্নিগ্ধতা নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা। কবির দৃষ্টিতে শরৎ রজনী এক মায়ামন্ত মোহনীয় কাব্যিক সময়ের ইন্দ্রজাল।।।। হেমন্ত। শরৎ-রাগীর বিদায় বার্তা ঘোষিত হলে হিমের ঘন ঘোমটায় নয়ন ঢেকে উপস্থিত হয় হেমন্ত। এ ঋতু যেন শরতের অসম্পূর্ণ কর্ম সমাপনের দায়িত্ব নিয়ে আসে। হেমন্তের আগমনে শসা ক্ষেতগুলো হরিদ্রা বর্ণ ধারণ করে। কৃষকদের ঘরে ঘরে ধান কাটার আয়োজন চলতে থাকে। কনক ধানে ভরে যায় মাঠ। এ সময় রাতে প্রচুর শিশির ঝরে। এ ঋতু কৃষককে যেন ডাক দিয়ে বলতে চায়-
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে মরি হয় হায় হায়
শীত:
হেমন্ত থেকে বসন্তের দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত যে ঋতু অঢেল খাদ্যশস্য ও টাটকা তরিতরকারির সওগাত নিয়ে হাজির হয় সে হল শীত। পৌষের পিঠে পুলি, মাথের খেজুরের রস জীবনের আনন্দ নিশ্চিত রূপেই বাড়িয়ে দেয়। শীতের হিমেল হাওয়া ও কুয়াশার চাদরে ঢাকা এ ঋতু নব বধূর মতই লাজুক। শীতের খেজুরের রসের পিঠা-পায়েসের গন্ধে চারিদিক মৌ মৌ করে। কবির ভাষায়-
বসন্ত:
শীতের নব বধূর ঘোমটা খুলে প্রকৃতিতে আসে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন। বসন্তে সমস্ত প্রকৃতি নব সাজে সজ্জিত হয়। মৌমাছি ফুলে ফুলে গুণগুণিয়ে গান গায় আর ফুলে ফুলে মধু পান করে বেড়ায়। কোকিলের কুহুরবে প্রকৃতি হয় মুখরিত। আমের শাখায় মুকুল দেখা দেয়। বসন্তে গাছে গাছে ফুলের সমারোহ ঘটে, ফুলের গন্ধে চারদিক আমোদিত হয়। যে দিকে চোখ যায় ফুল আর ফুল। প্রকৃতি সাজে অপরূপ সাজে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রেম প্রণলতায় মুগ্ধ হয়ে কবি গেয়েছেন-
ঢেউ জাগলে সমীরণে।
এ গেলো বাংলার সামগ্রিক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কিন্তু এর বাইরেও বাংলার ভূ-প্রকৃতিগত কারণে কিছু বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় এবং তার অন্য একটা রূপও প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন সমুদ্র ও সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। সাগরের নীল ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরে, ছোট ছোট লাল কাঁকড়া গুটি গুটি পায়ে তীর ঘেঁষে হেঁটে যায়, সাগরের বুকে ভেসে চলে ট্রলার, নৌকা। গোধূলি জলা সাগরের বুকে ধীরে ধীরে সূর্য অস্ত যায়। ফেনিল সাগরের মাঝখানে জেগে উঠা দ্বীপগুলোয় সারি সারি নারকেল আর সুপারির বাগান। সাগর প্রকৃতির গভীর মিতালি।
অরণ্য সজ্জা এক নয়নাভিরাম বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লীলাভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দর বন। বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে অবস্থিত এ বনে গেওয়া, কেওড়া, হোগলা, গোলপাতা ছাড়াও আরও নাম না জানা কত গাছপালা নিয়ে গড়ে উঠেছে এ বনভূমি। এখানে বাস করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বনবানরসহ বিভিন্ন ধরনের জীবজন্ত। বনের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ছোট নদী, সেসব নদীতে বাস করে কুমিরসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। এছাড়াও এখানে বাসকরে নানা পাখি। পাখি বাংলাদেশের ভূ-পরিবেশে যোগ করেছে লক্ষণীয় সৌন্দর্য। হয়তো এজন্যই কবি বলেছেন-
আপনে আপনা ভাষে গুণ গাত্র
উপসংহার:
ধনধান্য পুষ্পভরা বাংলাদেশ বিশ্বভূগোলে সৌন্দর্য-সম্পদে অপরূপ রূপের পসরা সাজিয়ে রূপের হাটে তার গৌরবময় অবস্থান। শ্যামল মাটির দূর্বাদল থেকে শুরু করে আকাশের নীলিমা পর্যন্ত সর্বত্রই এর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অবারিত ঐশ্বর্য। এখানকার প্রতিটি অভিক্ষিতকর উপাদানের মধ্যেও সংলগ্ন হয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন আভিজাত্য; যা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। গিরিনদী, মাঠ প্রান্তর আর অরণ্য-পর্বতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই হাতছানি প্রতি যুগে মুগ্ধ করেছে দেশি-বিদেশি মানুষকে, তাদের প্রাণে জাগিয়ে দিয়েছে আনন্দের বিলোল। তাইতো সৌন্দর্যমুখ কবির সঙ্গে আমরাও গেয়ে উঠি-
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।