বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট : কারণ ও উত্তরণের উপায়

বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট : কারণ ও উত্তরণের উপায়


যেকোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অপরিহার্য উপাদান বিদ্যুৎ। শিল্প, কলকারখানা, কৃষিকাজ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আধুনিক জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার থেকে শুরু করে উন্নয়নের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই। তবে কখনোই বাংলাদেশে চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি। কিন্তু ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ বিদ্যুৎ খাতকে দেওয়া হয় অগ্রাধিকার। এর প্রেক্ষিতে গত এক যুগে বাংলাদেশ বিদ্যুৎখাতে অর্জন করছে ব্যাপক সফলতা। ২০০৯ সালে ৪৭% বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্তি ব্যক্তি সেখানে ২০২২ সালে ১০০ শতাংশে এ পৌঁছেছে যা মুজিববর্ষের বাংলাদেশ সরকারের একটি লক্ষ্য ছিল। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বর্তমানে ২৫,৫১৪ মেগাওয়াট যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৪,৯২৪ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০,০০০ মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। তবে সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যোগানের স্বল্পতা এবং জ্বালানি তেলের দামের উর্দ্ধগতির কারণে অন্য দেশের ন্যায় বিদ্যুৎসংকটে পড়েছে বাংলাদেশও। দেশের জ্বালানি তেল ও গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন খুবই সংকটে।

বর্তমান বিদ্যুৎসংকটের কারণ:

বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্রমতে, বর্তমানে কয়লা থেকে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, গ্যাস থেকে ৫০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ফার্নেস ওয়েল থেকে ২৮ শতাংশ এবং ডিজেল থেকে ৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি তেলের যোগান কমেছে অনেকাংশে এবং পাশাপাশি জ্বালানির দামও বেড়েছে আর্ন্তজাতিক বাজারে। দেশের ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যের উর্দ্ধগতি আমাদেরকে ফেলেছে আর্ন্তজাতিক বাজার থেকে জ্বালানি ক্রয়ের অনিশ্চিয়তা। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ডলারের সংকটও রয়েছে। প্রতি বছর আমাদের দেশে জ্বালানির যে চাহিদা রয়েছে তা আমদানি নির্ভর।

বাংলাদেশ প্রতিবছর যে জ্বালানি আমাদানি করে তার ৪৪ শতাংশ ব্যয় করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এ পরিমাণ এলএনজি ক্রয়ের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে সংকট। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে হঠাৎ করে ইউরোপে বেড়ে গিয়েছে জ্বালানি চাহিদা। তাই এলএনজির দাম এখন আকাশচুম্মী। বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলার সংকটের কারণে এলএনজি কেনা বন্ধ রখেছে সরকার। এতে করে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে সরকার। কারণ কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয় শতভাগ আমদানিকৃত তরল জ্বালানি। বিপিসির তথ্য মতে এই আমদানিকৃত জ্বালানির ৪৪ শতাংশ বিদ্যুৎ, ৪০ শতাংশ পরিবহন খাতে এবং ৯ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ৪ শতাংশ শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। এ অবস্থায় জ্বালানি সাশ্রয়ের উদ্যোগের মাধ্যমে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রাখার ফলে ১১শ মেগাওয়াট ডিজেল পাওয়ার প্লান্ট সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে দিনে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত মাসের শুরু থেকে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানিও বন্ধ করেছে বাংলাদেশ । তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিকের তুলনায় কম হওয়ায় বিদ্যুৎসংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।

বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট : কারণ ও উত্তরণের উপায়

বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলায় করণীয় পদক্ষেপ:

বর্তমান সংকট যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী কোনো সংকট নয় সেহেতু বিদ্যুতের অপচয় রোধসহ জনগণকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। ইউরোপের প্রায় প্রত্যেক দেশের ন্যায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারের একগুচ্ছ স্বল্পমেয়াদী কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হলো: রাত আটটার পর দোকান-শপিংমল বন্ধ, সপ্তাহে একদিন বন্ধ থাকবে পেট্রলপাম্প, সরকার অফিসের সভা হবে ভার্চুয়ালি, নামাজের সময় ছাড়া মসজিদের এসি চালানোর নির্দেশ। গ্রিডভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক এবং জোনভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবারাহ পিক আওয়ারে দুই ঘণ্টা বন্ধ রাখার নির্দেশ। এভাবে যদি আমরা একটু সাশ্রয়ী হই এবং আমাদের যানবাহনে ব্যবহার একটু কম করি, তেল আমদানি যদি কম করি তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ কিছুটা কমবে। আমাদের অর্থনীতির উপর চাপ কমবে। এই তো গেলো বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলার স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা। তবে বিশেষজ্ঞরা বিদ্যুৎ সংকট উত্তরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়েছে। যেহেতু সরকার উচ্চমুল্যে জ্বালানি কিনে ভর্তুকি দিয়ে কুইক রেন্টার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে এবং ভর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎখাতে। সেহেতু সরকারকে এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর চাপ বা জ্বালানি তেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে হবে। অনেকগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও চালুও হবে শীঘ্রই। পায়রার ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলেও সঞ্চালন লাইন সম্পূর্ণ না হওয়ায় কেন্দ্রটির অর্ধেক ক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কেন্দ্রটির দিকেও সজাগ দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া চট্টগ্রামে ১২২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র চালু এ বছরে চালু হওয়ার কথা রয়েছে রয়েছে এবং বরিশালের ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র নিমার্ণের কাজ প্রায় শেষের দিকে। তাছাড়া গ্যাস অনুসন্ধান এবং গ্যাস উৎলোনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। জনসচেতার পাশাপাশি সরকারকে কঠিন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলায় অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্নকরণ ও সিস্টেম লস কমিয়ে আনার সর্বোচ্চ কমিয়ে আনার উপর জোর দিতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে উৎপাদিত বিদ্যুতের সুষমভাবে বণ্টনেরও। বায়োগ্যাসের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাছাড়া অপ্রয়োজনে বৈদ্যতিক বাতি, ফ্যান, এসি ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে এবং পাশাপাশি এনার্জি সেভিংস বাল্ব ব্যবহারে মনোযোগী হতে হবে। মোট কথা, বর্তমান বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি সর্বস্থরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।


আরো দেখুন :

সাজেশন : ৪৫তম বিসিএস
রচনা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্প
রচনা : পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
রচনা : তথ্য প্রযুক্তি ও বাংলাদেশ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top