রচনা : বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য


পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্রের বয়ে আনা পলি দ্বারা গঠিত পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। এই ভূখণ্ডটি যুগ যুগ ধরে জাতি-বিজাতি দ্বারা শাসিত হয়েছে। বাঙালির রক্তে যেমন মিশেছে অস্ট্রিক দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় প্রভৃতি জাতির রক্তধারা তেমনি এদের সংস্কৃতি সভ্যতায় সংমিশ্রণ ঘটেছে বিচিত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারা। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, মোঘল, সুলতান প্রভৃতি যুগে শাসকবর্গ তাঁদের শাসনকার্য ও আনন্দের অভিপ্রায়ে নির্মাণ ও রচনা করেছিলেন বিভিন্ন স্থাপনা ও পাণ্ডুলিপি, যা আজ বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন। বাংলাদেশের নানা স্থানে প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। নানাভিদ কারণে প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য আজ ধ্বংস ও অর্ধধ্বংস হয়ে গেছে। তবুও বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যমান ঐতিহ্য অনুসন্ধান করে বলা যায়, প্রাচীন যুগে বাংলার শিল্পকলা খুবই উন্নত ছিল।

প্রাচীন ঐতিহ্য:

‘ঐতিহ্য’ হচ্ছে পরস্পরাগত কথা, পুরুষানুক্রমিক ধারা, ঐতিহাসিক কথা, কিংবদন্তি, বিশ্রুতি, লোক প্রসিদ্ধি প্রভৃতি। বাংলাদেশে আজও প্রাচীন যা কিছু বিদ্যমান বা ধ্বংসপ্রায় তার সবই বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, স্থাপত্য-স্থাপনা, পুরাকীর্তি, লোকসাহিত্য, উৎসব, সামাজিক প্রথা অন্যতম।

প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় ঐতিহ্য:

বাংলাদেশের প্রাচীন ধর্মকর্মের ইতিহাস হলো জনপদবন্ধ প্রাচীন বাংলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের পূজা-অর্চনা, ভয়-ভক্তি, বিশ্বাস ও সংস্কারের ইতিহাস। প্রাচীন বাংলায় সমগ্র সংস্কৃতি রূপান্তরিত হয়ে আর্য ধর্মের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।

এখনো বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে নারী জাতির মধ্যে প্রচলিত বৃক্ষ পূজা, পূজা-পার্বণে আম্র পল্লব, ধান ছড়া, দূর্বা, কলা, পান সুপারি, নারকেল, ঘাট, সিঁদুর প্রভৃতির ব্যবহার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের দান। একইভাবে মনসাপূজা, শ্মশান কালীর পূজা, দুর্গাপূজা, ষষ্টীপূজা প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পরিচয় বহন করে।

খাসিয়া, মুডা, সাঁওতাল, রাজবংশী, বুনো, শাবর প্রভৃতি কৌমের লোকেরা তাদের আদিম পুরুষের মতো আজও দেবতার আসনে বসিয়ে গাছ, পাথর, পাহাড়, পশু-পক্ষী ও ফলমূলের পূজা করে থাকে। গুপ্ত আমলের তাম্রশাসন হতে জানা যায় যে, গুপ্ত রাজারা তাদের ধর্ম-কর্ম পরিচালনার জন্য বহু মন্দির ও তীর্থস্থান স্থাপন করেছিল, যা আজ বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য।

পাল পর্বে যে পৌরাণিক ধর্ম ও সংস্কারের বিস্তার দেখা যায়, সেন আমলে তা আরও বেশি প্রাসারিত হয়। সূর্যগ্রহণ, চন্দ্র গ্রহণ, দ্বাদশী তিথি, সংক্রান্তি ইত্যাদি উপলক্ষে স্নান, তর্পণ, পূজা ও পার্বণ, সুখরাত্রি ব্রত, হোলাকা, বর্তমান কালের হোলি উৎসব, জন্মাষ্টমী, নীতি পাঠের অনুষ্ঠান প্রভৃতি পৌরণিক কার্যকলাপ এ যুগেও ব্যাপকভাবে পরিলক্ষণ করা যায়। যা বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ।

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব ও রীতি-নীতি:

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে পূজা-পার্বণ, দূর্গার অর্চনা, বিজয়া দশমীর দিন শাবোরৎসব’, মহররম উৎসব, হোলি খেলা প্রভৃতি আচার অনুষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। বর্তমানের হোলিও উৎসব, গঙ্গাস্নান, মহাষ্টমীতে ব্রহ্মপুত্র স্নান, পূজা পার্বণ্যে অনুষ্ঠিত নানাবিধ উৎসব আজও বাংলাদেশে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।

বাংলাদেশের বিবাহ অনুষ্ঠান, তীর্থ গমন, খাদ্য ও কর্ম নিষিদ্ধরীতি, কাল শুভ-অশুভ সে বিষয়ে শাস্ত্রের অনুশাসন প্রভৃতি বাংলায় ঐতিহ্য।

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ‘পহেলা বৈশাখ’ উৎসব। বাঙালির ঐতিহ্যের সম্মুখ প্রমাণ হিসেবে আজও সাক্ষী হয়ে আছে। বৈশাখী উৎসবকে কেন্দ্র করে যে প্রথা ও রীতি চালু আছে তা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ। তাছাড়াও বাংলাদেশে বিভিন্ন সংক্রান্তি পালিত হয় তা বাংলার লোক ঐতিহ্যের অংশ।

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য:

নয় ও দশ শতকের আগে বাংলা ভাষার নির্দিষ্টরূপ জানা না গেলেও এই শতকগুলোতে সংস্কৃতি ছাড়াও দুই ভাষা প্রচলিত ছিল। এর একটি হলো শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং অন্যটি মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় গৌড় বঙ্গীয় রূপ, যাকে বলা যায় প্রাচীনতম বাংলা ভাষা। একই লেখক এ দুই ভাষাতেই পদ, দোহা ও গীত রচনা করেছেন। বাংলা ভাষার এরূপ প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপাল হতে সংগৃহীত চারটি প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথিতে। এগুলো ‘চর্যাপদ’ নামে পরিচিত। এখন পর্যন্ত মোট সাড়ে ৪৬টি চর্যাপদ পাওয়া গেছে। এ চর্যাপদগুলোর মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। বাংলা সাহিত্যের জন্ম ও এই প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে। পরবর্তী যুগে বাংলায় সহজিয়া গান, বাউল গান, বৈষ্ণব পদাবলীর উৎপত্তি হয়। সুতরাং বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত চর্যাপদ।

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য, স্থাপত্য ও শিল্পকলা :

স্থাপত্য ও শিল্পকলা বাংলাদেশের নানা স্থানে প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। নানবিধ কারণে প্রাচীন বাংলার শিল্পকলা ধ্বংস হয়ে গেছে। তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রাচীন যুগে বাংলার শিল্পকলা খুবই উন্নত ছিল।

স্থাপত্যঃ

প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন অতিসামন্য আবিষ্কৃত হয়েছে। চীন দেশের ভ্রমণকারী ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাংয়ের বিবরণী ও প্রাচীন শিলালিপি থেকে প্রাচীন যুগে বাংলার কারুকার্যময় বহু কর্ম, চূড়া, শিখা, মন্দির স্তূপ ও বিহারের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।

স্তূপ:

প্রাচীন বাংলায় কিছু বৌদ্ধ ও জৈন স্তূপ নির্মিত হয়েছিল। ঢাকা জেলার আশরাফপুর গ্রামে রাজা দেব খড়গের ব্রোঞ্জ বা অষ্টধাতু নির্মিত স্তূপ পাওয়া গেছে। এটিই সম্ভবত বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন স্তূপের নিদর্শন। রাজশাহীর পাহাড়পুর এবং চট্টগ্রামের বেওয়ারিতে আরও দুইটি ব্রোঞ্জের তৈরি স্তূপ পাওয়া গেছে। এছাড়া রাজশাহীর পাহাড়পুরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইটের তৈরি স্তূপ পাওয়া গেছে।

বিহার:

বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নির্মিত বেশ কয়েকটি বিহারের সন্ধান মেলে । পাল যুগে অধিকাংশ বিহার নির্মিত হয়েছিল যা আজও প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে তার ধ্বংস স্তূপ আবিষ্কৃত হচ্ছে। রাজশাহীর পাহাড়পুরে যে বিশাল বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হয়েছে তা প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। জানা যায় আট শতকে ধর্মপাল বিহারটি নির্মাণ করেন।

তাছাড়াও সোমপুর বিহার এর খ্যাতি সারা বিশ্বে। পাল আমলে নির্মিত এই বিহার নওগাঁ জেলার সোমপুরে অবস্থিত। ‘সোমপুর বিহার’ ছাড়াও ধর্মপাল ‘বিক্রমশীল বিহার’ ও ‘ওদন্তপুর বিহার’ নামে আরও দুটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন। পাল আমলের ছোট বড় আরও কয়েকটি বিহারের সন্ধান মেলে কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বিহার, চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহার প্রভৃতি । প্রাচীন এক নগর সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে নরসিংদী জেলার বেলাব, শিবপুর ও রায়পুর উপজেলায়। এখানে ৫০টি প্রত্নস্থান আবিষ্কৃত হয়েছে যার মধ্যে বৌদ্ধ বিহারও রয়েছে। এছাড়াও বৌদ্ধধর্মের প্রচারক ও পন্ডিত অতীশ দীপংকরের জন্মস্থান বিক্রমপুরে প্রাচীন বজ্রযোগীনী গ্রামে সম্প্রতি একটি বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। যা বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ।

মন্দির:

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের তালিকায় মন্দির স্থাপনা বিশেষ স্থান অধিকার করেছে এসব মন্দির আজ সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। কেবল আট শতক হতে কয়েকটি ভাঙ্গা ও অর্ধভাঙ্গা মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া যায়।

এসব বৌদ্ধ মন্দির পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, রাঢ়, বরেন্দ্র প্রভৃতি অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে পাহাড়পুরের মন্দির এক অমর সৃষ্টি। এ উপমহাদেশের ইতিহাসে পাহাড়পুরের মন্দিরের গুরুত্ব অপরিসীম, কেননা উপমহাদেশে অবশিষ্ট অঞ্চলের স্থাপত্য শিল্পকে এটি গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। দিনাজপুর জেলার বানগড়ে প্রস্তর নির্মিত এবং চট্টগ্রামের কেওয়ারিতে ব্রোঞ্জের তৈরি মন্দির পাওয়া গেছে।

মসজিদ, কবর, প্রসাদ, দরগাহ:

বাংলাদেশের প্রাচীন, ঐতিহ্যের একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে বিভিন্ন স্থানে সময়ে অনেক প্রসাদ, মসজিদ, কবর, দরগাহ প্রভৃতি। সুলতানি আমলে নির্মিত এসব মসজিদ এর অনেকগুলো এখন ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। করে ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সিকান্দার শাহ কর্তৃক নির্মিত আদিনা মসজিদ। এই মসজিদের পার্শ্বে সিকান্দার শাহের কবর নির্মিত হয়েছে। বিশেষ বর্তমান ঢাকা হতে ১৫ মাইর দূরে সোনারগাঁওয়ে গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের মাজার নির্মিত হয়েছে। এই কবরের অতি নিকটে পাঁচটি দরগাহ ও পাঁচটি মসজিদ আছে। এগুলো ‘পাঁচ পীরের দরগাহ’ নামে পরিচিত।

১৪১৮-১৪২৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান জালালউদ্দিন কর্তৃক নির্মিত ‘একলাখী মসজিদ’ অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য। তখনকার দিনে এক লাখ টাকা ব্যয় করে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে এর নাম ‘এক লাখী মসজিদ’ ।

বড় সোনা মসজিদের আরেক নাম ‘বার দুয়ারী মসজিদ’। এটি আসাম বিজয়কে স্মরণ করে রাখার জন্য হুসেন শাহ নির্মাণ আরম্ভ করলেও নুসরত শাহ নির্মাণ কাজ শেষ করেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে ওয়ালী মুহম্মদ কর্তৃক নির্মিত গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন।

বাগেরহাট জেলায় ‘খান জাহান আলীর সমাধি ও ষাট গম্বুজ মসজিদ’ বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। এই মসজিদটি পনের শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়েছিল, তুর্কি সেনাপতি ও ইসলামের একনিষ্ট সাধক উলুখ খান জাহান এ মসজিদ নির্মাণ করেন। এই স্থাপত্যকর্মটি জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বসভ্যতার নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

এছাড়াও গৌড়ের ‘কদম রসুল’ মসজিদ, ঢাকা জেলার রামপালে ‘বাবা আদমের মসজিদ’ লালবাগর শাহি মসজিদ প্রভৃতি বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন।

মসজিদ ও সমাধি সৌধ ছাড়াও এ যুগের নির্মিত বিভিন্ন তোরণ-কক্ষ, মিনার মুসলমান বাংলার স্থাপত্য শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এদের মধ্যে কনউদ্দিন বরবক শাহ নির্মিত গৌড়ের ‘দাখিল দরওয়াজা’ আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সমাধি তোরণ, ফিরোজ মিনার উল্লেখযোগ্য।

মোঘল আমলে বাংলার শাসকগণ শিল্পকলার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অবদান রেখে গেছেন। আজও বাংলার বহু স্থানে মুঘল শাসকগণের শিল্পপ্রীতির নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতার বহুসংখ্যক মসজিদ, সমাধি ভবন, স্মৃতিসৌধ, মাজার, দূর্গ, তোরণ নির্মিত হয়েছে।

মোঘল যুগে ‘কাটরা’ নামে বেশ কয়েকটি দালান তৈরি করা হয়েছিল। শাহ সুজা কর্তৃক নির্মিত ঢাকার বড় কাটরা, এটি চকের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত, সুবাদার মীর জুমলা কর্তৃক নির্মিত হাজীগঞ্জ দূর্গ, শায়েস্তা খান নির্মিত ছোট কাটরা ও লালবাগ কেল্লা, সাত গম্বুজ মসজিদ প্রভৃতি বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক।

ভাস্কর্য:

বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যমান নমুনা থেকে সহজে অনুমেয় যে, বাংলায় স্থাপত্য শিল্পের পাশাপাশি ভাস্কর্য শিল্পের চর্চাও হয়েছিল অনেক স্থানে মন্দির ধ্বংস হলেও তার মধ্যে দেবমূর্তি রক্ষিত রয়েছে আজও। সম্প্রতি মহাস্থানগড়ে বেশ কয়েকটি দেবমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। পাহাড়পুরের মন্দির গাত্রে খোদিত পাথর ও পোড়া মাটি ফলক থেকে বাংলার নিজস্ব ভাস্কর্য শিল্পের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। বিষয়বস্তু ও শিল্প কৌশলের দিক দিয়ে বিচার করলে পাহাড়পুরের ভাস্কর্য শিল্পকে লোকশিল্প ও অভিজাত শিল্পের তালিকায় বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্য বলা চলে।

পাহাড়পুরের ভাস্কর্যে রামায়ণ-মহাভারতের অনেক কাহিনী এবং কৃষ্ণলীলার কথা খোদিত আছে যা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়াও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কথাও এ ভাস্কর্যে রূপ দেওয়া হয়েছে। খোদিত ভাস্কর্য ছাড়াও প্রাচীন বাংলার পোড়ামাটির শিল্প খুবই উন্নত ছিল।

কুমিল্লার ময়নামতি ও লালমাই পাহড়ে বেশকিছু পোড়ামাটির ফলক ও মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। পণ্ডিতবর্গ এগুলোকে মৌর্য, গুপ্ত, কৃষাণ ও পাল যুগের বলে অনুমান করেছেন।

বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য ও চিত্রশিল্প:

পাল যুগের পূর্বেকার চিত্র আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি কিন্তু প্রাচীনকালেই বাংলায় যে চিত্র অঙ্কনের চর্চা ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাধারণত বৌদ্ধ বিহার, মন্দিরের দেয়াল সৌন্দর্যময় করার রীতি প্রচলিত ছিল। যা আজ বাংলার ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে বিদ্যমান। তখনকার দিনে বৌদ্ধ লেখকেরা তালপাতা অথবা কাগজে তাদের পুস্তকের পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেন। এসব পুঁথি চিত্রায়িত করার জন্য লেখক ও শিল্পীরা ছোট ছোট ছবি আঁকতেন। রাজা রামপালের রাজত্বকালে রচিত ‘অষ্ট সাহস্ৰিকা প্রজ্ঞাপরামিতা’ পুথি বাংলার চিত্র শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। রেখার সাহায্যে চিত্রাঙ্কনের আর একটি দৃষ্টান্ত হলো সুন্দরবনে প্রাপ্ত ডোম্মন পালের তাম্র শাসনের অপর পিঠে উৎকীর্ণ বিষ্ণুর রেখাচিত্র। প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত দেবদেবীর মূর্তি প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যের এক শাশ্বত নিদর্শন। শিল্পীর শিল্পকৌশল ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় এতে লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য

প্রাচীন সভ্যতা ও প্রত্নতত্ত্ব:

বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ও বর্তমানে আবিষ্কৃত প্রাচীন সভ্যতা ও প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনসমূহই প্রমাণ করে, এক সময় তথা প্রাচীনকালে বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি কতটা উন্নতি লাভ করেছিল। বাংলাদেশে বর্তমান বিদ্যমান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়লা পাহাড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, নরসিংদি ওয়ারি বটেশ্বর প্রভৃতি।

মহাস্থানগড়:

বগুড়া শহর থেকে ১৩ কি.মি. উত্তরে করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে মহাস্থানগড় এটি বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন, যা সমতল ভূমি থেকে ৬ মিটার উঁচু প্রতিরক্ষা প্রাচীর দ্বারা স্থানটি পরিবেষ্টিত। প্রাচীরের অভ্যন্তরে রয়েছে সুলতান মহীসওয়ারের মাজার ও মোঘল সম্রাট ফররুখ সিয়ার এর একটি মসজিদ মহাস্থানগড়ের অদূরেই অবস্থিত বেহুলা-লক্ষিণ বাসর ঘর। মহাস্থানগড় প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল যা এর প্রত্ননিদর্শন হতে সহজেই অনুমেয়।

ময়নামতি:

কুমিল্লা শহর হতে ৮ কিমি দূরে অবস্থিত ময়নামতি। মধ্যযুগের পাল শাসনামলের বৌদ্ধ সভ্যতার এক ঐতিহাসিক নিদর্শন ময়নামতি । ঐতিহাসিকদের মতে, রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী ময়নামতির নামানুসারে এই ঐতিহাসিক স্থানটির নাম রাখা হয় ময়নামতি। সভ্যতার অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আজও বিদ্যমান রয়েছে কুমিল্লার ময়নামতিকে ঘিরে। শালবন বিহার, আনন্দ বিহার প্রভৃতি কার বিহারের ধ্বংসাবশেষ ময়নামতিতে বিদ্যমান। ময়নামতিতে বর্তমানে একটি সেনানিবাস রয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি ব্রিটিশ যুদ্ধঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

পাহাড়পুর:

রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলায় অবস্থিত পাহাড়পুর বাংলাদেশের বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির ঐতিহাসিক নিদর্শন। এখান পাওয়া গেছে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বিহার সোমপুর বিহারের ধ্বংসাবশেষ। ঐতিহাসিকদের মতে অষ্টম শতাব্দীতে পাল রাজত্বকালে রাজা ধর্মপাল সোমপুর বিহার নির্মাণ করেছিলেন। পাহাড়পুরে ১৮৯টি কুঠুরি ও ৯৮টি পূজার জন্য উঁচু বেদী রয়েছে। কুমি পাথর নির্মিত দেয়ালের গায়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ দেব-দেবীর ৬৩টি মূর্তি খোদাই করা আছে। সোমপুর বিহারের চারপাশে রয়েছে ১৭ আবাসিক কক্ষ, প্রবেশ পথ, ছোট ছোট স্তূপ ও মন্দির।

উয়ারি বটেশ্বর:

অতি সম্প্রতি উয়ারি বটেশ্বর প্রত্নস্থানে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগর সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। নরসিংদী জেলার বেলাব, শিবপুর ও রায়পুর উপজেলায় অবস্থিত প্রত্ন অঞ্চলটির ৫০টি প্রত্নস্থান থেকে আবিষ্কৃত হচ্ছে প্রাগৌতিহাসিক যুগের পথ।ও প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম কাঠের হাতিয়ার, তাম্র প্রস্তর সংস্কৃতি গর্ত বসতি প্রভৃতি প্রস্থ বস্তু ওয়ারি বটেশ্বর ছিল বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগর রাজধানী। ইতোমধ্যে এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে মাটির দূর্গ প্রাচীর, পরিখা, পাকা রাস্তা, ইট নির্মিত স্থাপত্য কীর্তি। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় অবস্থিত ওয়ারি বটেশ্বর ছিল একটি নদী বন্দর ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র।

তাছাড়াও বাংলার লোক ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন হলো তালপাতার পাখা, পালকি, ঘোড়ার গাড়ি প্রভৃতি আজও ব্যবহৃত যন্ত্রাদি। সেসব লোকসংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে – মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, পালাগান, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, রুপকথা, উপকথা, শ্রুতিকা লোককাব্য ও পুঁথি গ্রন্থ । বাংলাদেশে সংরক্ষিত বিভিন্ন অষ্টধাতু ও কালো কষ্টি পাথর নির্মিত মূর্তিগুলো বাংলার ঐতিহ্যের অংশ।

সর্বোপরি বলা যায়, বিভিন্ন শাসনামলে প্রাপ্ত লিপি, শিলাখণ্ড, তাম্র শাসন প্রভৃতি বাংলার ঐতিহ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। তাছাড়া বিভিন্ন রাজা-সুবেদার, নায়েব ও জমিদারদের আমলে নির্মিত স্থাপনা ও ভাস্কর্যগুলো আজ বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক নিদর্শন। বিভিন্ন আমলে প্রচলিত আচার-প্রথা, রীতি-নীতি, সমাজ-শাসন প্রভৃতি যা পরম্পরায় আজ কোনো না কোনোভাবে আমাদের হাতে বিদ্যমান তা বাংলাদেশের প্রাচীন লোক ঐতিহ্যের অংশ। সব মিলে প্রাচীন আমলে সৃষ্ট সকল নিদর্শন যা আজ ধ্বংস ও অর্ধধ্বংস প্রাপ্ত তার সবই বাংলার ঐতিহ্যের অংশ।


আরো দেখুন

রচনা : একজন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
অনুচ্ছেদ : পদ্মা সেতু
অনুচ্ছেদ : ঢাকা মেট্রোরেল
সাধারণ জ্ঞান : পদ্মা সেতুর আদ্যেপান্ত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top