ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (NEC) সভায় “বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০” নামে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের অনুমোদন পেয়েছে। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন ও পানি, জলবায়ু, পরিবেশ ও ভূমির টেকসই ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূরীকরণসহ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাংলাদেশের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা সমূহের সমন্বয় করবে।
১. ব-দ্বীপ পরিকল্পনা (Delta Plan) কী:
ইংরেজি শব্দ ‘Delta’ অর্থ ‘ব-দ্বীপ’। নদীর মোহনায় অবস্থিত প্রায় ব-অক্ষরের আকারবিশিষ্ট যে দ্বীপ, তাকেই বলা হয় ডেল্টা। বাংলাদেশ বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ অঞ্চল। নদীমাতৃক এ দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে যথাযথ পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের ওপর। বাংলাদেশ যখন ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হবার স্বপ্ন দেখছে, তখন সঠিক নদীও পানি ব্যবস্থাপনার অভাবে এবং বন্যা, খরা ও আরো নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাংলাদেশ বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের এই সমস্যা বহুলাংশে কাটিয়ে উঠতে পারে।
২. ব-দ্বীপ পরিকল্পনার গুরুত্ব:
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ তে উচ্চতর পর্যায়ের ৩টি জাতীয় অভীষ্ট এবং ব-দ্বীপ সংশ্লিষ্ট ৬টি নির্দিষ্ট অভীষ্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। ব-দ্বীপ সংশ্লিষ্ট অভীষ্টসমূহ উচ্চতর পর্যায়ের অভীষ্ট অর্জনে অবদান রাখবে।
২.১. উচ্চ পর্যায়ের অভীষ্ট :
অভীষ্ট- ১ : ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ;
অভীষ্ট- ২ : ২০৩০ সালের উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন; এবং
অভীষ্ট- ৩ : ২০৪১ সালে নাগাদ একটি সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন।
২.২. ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’র নির্দিষ্ট অভীষ্টসমূহ :
অভীষ্ট- ১ : বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিপর্যয় থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা;
অভীষ্ট- ২ : পানি নিরাপত্তা এবং পানি ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা বৃদ্ধি করা;
অভীষ্ট- ৩ : সমন্বিত ও টেকসই নদী অঞ্চল এবং মোহনা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা;
অভীষ্ট- ৪ : জলাভূমি ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং তাদের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা;
অভীষ্ট- ৫ : অন্তঃ ও আন্ত-দেশীয় পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও ন্যায়সঙ্গত সুশাসন গড়ে তোলার এবং
অভীষ্ট- ৬ : ভূমি ও পানি সম্পদের সর্বোত্তম সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।
“যদি কখনও সময় পাও, তবে নেদারল্যান্ড ভ্রমণ করে এসো, কারণ এটি আমাদের মতই নদীমাতৃক দেশ”
— রাশিয়া ভ্রমণকালীন সময়ে কণ্যাদের উদ্দেশ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৩. ব-দ্বীপ পরিকল্পনা- ২১০০:
ব-দ্বীপ পরিকল্পনাটি হল বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের অধীন General Economic Division (GED) এবং নেদারল্যান্ডস সরকারের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তার ফসল।
অফিসিয়াল নাম: “বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ প্রণয়ণ প্রকল্প”
অর্থনৈতিক সহায়তায়: নেদারল্যান্ডস সরকার
কারিগরি সহায়তায়: Dutch-Bangladeshi BanDuDeltAS consortium and Bangladesh Policy Research Institute
সমঝোতা স্মারক: সমঝোতা স্মারক হয় ১৬ জুন, ২০১৫। পানিসম্পদ নিয়ে ১০০ বছরের ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।
অনুমোদন: National Economic Council (NEC) ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮তে অনুমোদন দেয়।
মূল লক্ষ্য: “জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো”।
জিডিপিতে অবদান: জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৫% বৃদ্ধির মাধ্যমে ১০% গিয়ে দাঁড়াবে।
৪. ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এর বিশ্লেষণী কাঠামো:
১ম পদক্ষেপ (২০২০-২০৩০): এটিতে প্রায় ২,৯৭,৮২৭ কোটি টাকা খরচ নির্বাহ হবে। এর অধীনেই থাকবে ৮০টি প্রকল্প।
২য় পদক্ষেপ (২০৩১-২০৫০): প্রথম পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পর দ্বিতীয় পদক্ষেপের কাজ শুরু হবে।
৩য় পদক্ষেপ (২০৫১-২১০০): পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় পদক্ষেপের পর তৃতীয় পদক্ষেপের কাজ শুরু হবে। এটি ২১০০ সাল পর্যন্ত চলবে।
পরিকল্পিত ১০০ বছরের প্রথম ১০ বছরে, অর্থাৎ ২০২০-৩০ সালের মধ্যে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই অর্থ ব্যয় হবে মোট ৮০টি প্রকল্পে। প্রস্তাবিত ৮০টি প্রকল্পে এই টাকা খরচ করতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৫% বেড়ে ১০%-এ উন্নীত হবে।
পরিকল্পনা প্রণয়নে দেশের ৮ টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলকে ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোকে অভিন্ন গ্রুপ বা হটস্পটে আনা হয়েছে। এভাবে দেশে মোট ৬টি হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে।
[table id=7 /]
সূত্র: বিডিপি ২১০০ বিশ্লেষণ, জিইডি (২০১৫) এবং উপকূলীয় অঞ্চল নীতিমালা-২০০৫
৫. ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এর বিনিয়োগ ব্যয় এবং অর্থায়ন:
ব-দ্বীপ পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে মোট মূলধন বিনিয়োগ ব্যয় ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। এই তহবিলের সম্ভাব্য উৎস:
১. বাংলাদেশ সরকার
২. উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহ
৩. পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কিত তহবিল (Green Climate Fund) এবং
৪. সরকরি বেসরকারি অংশীদারত্ব (Public Private Partnership PPP) |
৬. ডেল্টা চ্যালেঞ্জসমূহ:
১. জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব (তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত, বন্যা, খরা, নদী ভাঙ্গন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস)।
২. উজানের দেশগুলোর বাঁধনির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড।
৩. জলাবদ্ধতা।
৭. ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা:
১. রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
২. মৎস্য খাতে মূল্য সংযোজন এবং কর্মসংস্থান অনেকাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩. নৌ-পরিবহনের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
৪. সুনীল অর্থনীতির বিকাশের অপার সম্ভাবনা।
৫. পর্যটন কেন্দ্রের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন।
জাতীয়ভাবে সুবিবেচিত, সমন্বিত ও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল কার্যকর কৌশল অবলম্বন এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ন্যায়সঙ্গত সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এবং অন্যান্য ব-দ্বীপ সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলা করে দীর্ঘমেয়াদে পানি ও খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে ‘নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত সহিষ্ণু সমৃদ্ধশালী ব-দ্বীপ গড়ে তোলার জন্যই এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য অপার সম্ভাবনা বয়ে আনবে।
“In order to illustrate the role of BDP 2100 and its contribution to the long term development of Bangladesh, two policy options are considered. One is called the Business As Usual (BAU) policy and another is Delta Plan-2100”
-Dr. Shamsul Alam
(Senior Secretary, General Economics Division,
Bangladesh Planning Commission and coordinating lead Author of Bangladesh Delta Plan 2100)
আরো দেখুন
অনুচ্ছেদ : পদ্মা সেতু
অনুচ্ছেদ : মেট্রো রেল
রচনা : বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য
রচনা : স্বদেশপ্রেম (১৬ টি পয়েন্ট)
ক্যারিয়ার টিপস : সেন্ট্রাল ব্যাংকার হওয়া যাদের স্বপ্ন