রচনা : মহামারিতে নারীর প্রতি বৈষম্য

মহামারিতে নারীর প্রতি বৈষম্য (Shadow Pandemic)


কোভিড-১৯ মহামারীর গোড়ার দিকে, বিশ্ব বাড়িতে থাকুন” এবং “শেন্টার-ইন-প্লেস আদেশের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে। করেন ভাইবাস মহামারির মধ্যে আমাদের নিরাপদ রাখতে অভূতপূর্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে, বিশ্বব্যাপী অগণিত নারীর জন্য যারা পারিবারি সহিংসতার সম্মুখীন হচ্ছে, বাড়ি একটি নিরাপদ স্থান নয়। নির্যাতন থেকে বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা হঠাৎ তাদের সম্ভাব্য নির্যাতনকারীদের সাথে নিজেকে বন্ধ ঘরে দেখতে পান। জোরপূর্বক সহাবস্থান, চাকরি হারানো, ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে উদ্বেগ পারিবারিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে, যা অনেক পুরুষকে নির্যাতনকারীতে পরিণত করেছে এবং বিদ্যমান নির্যাতনের হারকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মহামারীর পর থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষ করে গার্হস্থ্য সহিংসতা তীব্রতর হয়েছে। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের পর থেকে, সামনের সারিতে থাকা ব্যক্তিদের কাছ থেকে উঠে আসা তথ্য এবং প্রতিবেদনগুলি দেখিয়েছে যে নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতা, বিশেষ করে গার্হস্থ্য সহিংসতা তীব্র হয়েছে।

 

“বিশ্বব্যাপী প্রতি তিনজনের একজন নারী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একজন অন্তরঙ্গ সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হন। নারী, মেয়েদের প্রতি সহিংসতা মানবাধিকার লঙ্ঘন। মহামারীর সময়ে ১৫-৪৯ বছর বয়সী ২৪৩ মিলিয়ন মহিলা এবং মেয়েরা একজন অন্তরাঙ্গ দ্বারা যৌন এবং/অথবা শারীরিক সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছিল।”

– UN WOMEN

করোনায় নারী ও পুরুষ আক্রান্ত হয়েছেন। ক্ষতি বেশি হয়েছে নারীর। করোনাকালে ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা মহামারি, যুদ্ধ, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়ের সময় নারী ও পুরুষের অবস্থানগত পার্থক্য আরও প্রকট হয়। চলমান করোনা মহামারি তার ব্যতিক্রম নয়। এই মহামারির সময় বৈশ্বিকভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন বাড়তে দেখা গেছে, তেমনি এই মহামারিকালে নারীরা আর্থিক স সামাজিকভাবে আরও বেশি অসহায়ত্বের মধ্যে পড়েছেন। বাংলাদেশেও এই পরিস্থিতি দেখা গেছে। করোনা মহামারি শুরুর এক বছর পর পর বছর মার্চে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২১’ বলেছিল, কোভিড-১৯ মহামারি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি সমাজ গড়ে তুলতে নতুন বাধার সৃষ্টি করেছে। আগে থেকে থাকা বা বিরাজমান নারী-পুরুষের বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এই মহামারি। মহামারির কারণে মানুষ কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে থেকেছে, মানুষকে ঘরে বন্দী থাকতে হয়েছে। মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মানুষের অসহায়ত্ব যেমন বেড়েছে, একইভাবে সহায়তা বাড়েনি। কারণ, সমাজে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সহায়তা ও সেবার যে ব্যবস্থা ছিল তা মহামারিতে ক্ষতিগ্রন্থ হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে ভেঙে পড়েছে। এর চাপ বেশি পড়েছে নারীর ওপর। মহামারির শুরুতে ২০২০ সালের মার্চে জাতিসং জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বলেছিল, রোগের প্রকোপ পুরুষ ও নারীর ওপর ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা খাতের বৈশ্বিক জনবলের ৭০ শতাংশ নারী। তাঁদের ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। দুশ্চিন্তা-উত্তেজনা বেড়ে গেলে সঙ্গীর হাতে নির্যাতন বা পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যেতে পারে। যৌন ও প্রজনন অধিকারের লঙ্ঘন হতে পারে। ইউএনএফপিএ তখন বেশ কিছু সুপারিশও করেছিল।

আবু জামিল ফয়সালের আরেকটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের মে থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত এক বছরে একটি খাওয়ার বড়ির (সুখী) ব্যবহার কমেছে প্রায় ১ শতাংশ। এর অর্থ নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করতে হয়েছে।

মহামারিতে নারীর প্রতি বৈষম্য

আন্তর্জাতিক একাধিক প্রতিষ্ঠান নারীর ঝুঁকির বিষয়গুলো নিয়ে সতর্ক করলেও নীতিনির্ধারকেরা যথাযথ মনোযোগ দেননি বলে অভিযোগ আছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারী সংখ্যালঘু। মহামারি মোকাবেলায় দেশে দেশে যে তৎপরতা দেখা গেছে, নারীর বিশেষ বিশেষ সমস্যার কথা তাতে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পেয়েছে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে (২০২০) বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। রোগী শনাক হওয়ার আগেই স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা মহামারিবিষয়ক জাতীয় নীতি ও কর্মকৌশল এবং পরবর্তী সময় জাতীয় করোনা টিকা প্রযোগ পরিক্যান তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলেন, এই দুটি ও নীতিতে নারীদের ব্যাপাতে পৃথক গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ কিছু বলা হয়নি।

কিছু বাস্তব ঘটনা

  • সাম্প্রতিক ভেটা থেকে দেখায় যে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর থেকে অনেক দেশে গার্হস্থ্য সহিংসতার হেল্প লাইনে কল বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • রাস্তায়, পাবলিক প্লেসে এবং অনলাইনে মহিলাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি এবং অন্যান্য ধরনের সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।
  • জীবিতদের উপলব্ধ পরিষেবা সম্পর্কে সীমিত তথ্য এবং সচেতনতা এবং সহায়তা পরিসেবাগুলিতে সীমিত অ্যাক্সেস রয়েছে ।
  • কিছু দেশে, মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে নেয়া তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ কার্যক্রম সরিয়ে নিয়ে কোভিত-১৯ ত্রাণের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে ।

সেবা কম পেয়েছেন নারী

পেয়েছেন নারীজন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার এবং প্রয়োজনের সময় তা না পাওয়া (অপূর্ণ চাহিদা) নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের দুজন গবেষকের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, মহামারির সময় বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর অপূর্ণ চাহিদা কোনো কোনো জেলায় বেড়ে ২৪-২৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ প্রয়োজনের সময় ওইসব জেলার ২৪-২৫ শতাংশ দম্পতি হাতের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পাননি। গত পাঁচ দশকে অপূর্ণ চাহিদার হার ক্রমাগতভাবে কমতে দেখা গেছে। মহামারি শুরুর আগে অপূর্ণ চাহিদার হার ছিল ১২। মহামারিকালে নারীদের মধ্যে জননিয়ন্ত্রণের দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি ইমপ্ল্যান্ট বা ইনজেকটেবলের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু এসব সামগ্রী দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট দেখা গিয়েছিল।

মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন সূত্র বলছে, বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার বেড়েছে। বাড়িতে প্রসবে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা কম পাওয়া যায়। বাড়িতে প্রসবে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি সব সময় বেশি দেখা যায়।

মহামারিতে নারীর প্রতি বৈষম্য

বাংলাদেশের দম্পতিদের মধ্যে পুরুষদের চেয়ে নারীদেরই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বেশি ব্যবহার করতে দেখা যায়। মহামারির সময় নারীরাই মূলত জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্ৰী পাননি। নারীর গর্ভধারণকালে, প্রসবের আগে এবং প্রসব-পরবর্তী সেবার প্রয়োজন। সেই সেবাও নারীরা মহামারির সময় কম পেয়েছেন। বিধিনিষেধ বা চলাচলের বিধিনিষেধের কারণে নারীরা সেবাকেন্দ্রে যেতে পারেননি, সেবা নেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। অথবা সেবাকেন্দ্রে সেবাদান করা ব্যক্তি উপস্থিত থাকতে পারেননি। এতে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, মহামারির শুরু থেকে নারীর ব্যাপারে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, জরুরি সরবরাহ ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয় গুরুত্ব পায়নি। এমআর (মাসিক নিয়মিতকরণ) বেড়েছে এবং এমআরজনিত জটিলতাও বেড়েছে। সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যাও কিছু বেড়েছে। মাতৃ্যস্থা নিয়ে কাজ করে এমন সূত্র বলছে, বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার বেড়েছে। বাড়িতে প্রসবে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা কম পাওয়া যায়। বাড়িতে প্রসবে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি সব সময় বেশি দেখা যায়।

টান পড়েছে নারীর জীবিকায়

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে ‘সকডাউন’ কার্যকর করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এর প্রভাব পড়ে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে। মানুষ কর্মক্ষেত্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকে, বিরত থাকতে বাধ্য হয়। মহামারির এই চাপ অনুভূত হয় সারা বিশ্বে। চাপে পড়েন বাংলাদেশের নারীরাও। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে ২০২০ সালে জরিপ করেছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল, প্রতি ১০ জনে ৯ জন শ্রমিক বা কর্মী কোনো না কোনোভাবে কাজ নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ শ্রমিক বা কর্মী বলেছিলেন, যাতায়াতে বিধিনিষেধের কারণে তাঁরা কাজে যো পারেননি। তাঁদের ৫২ শতাংশ বলেছিলেন, তাঁরা করোনার কারনে কাজ হারিয়েছেন। বিধিনিষেধের কারনে কাজ হারানোর হার নারীদে মধ্যে বেশি ছিল। কাজ হারানো মানুষের মধ্যে ৫৮ শতাংশ ছিলেন নারী, পুরুষ ছিলেন ৪৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ১ কোটি ৬০ লাখ নারী শ্রমশক্তিতে নিয়োজিত আছেন। তাঁদের মধ্যে ১২ শতাংশ বা ১ কোটি ৪৭ লাখের বেশি নারী কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। অনানুষ্ঠানিক খাতের কিছু কাজ আছে যেখানে প্রায় ১০০ শতাংশ নারী কাজ করেন।

মহামারিতে নারীর প্রতি বৈষম্য

এই সময় অনানুষ্ঠানিক যাতের শ্রমিক ও কর্মীরা কিছু সমস্যার কথা বলেছিলেন। যেমন: তাঁরা কাজে যেতে পারেন না, তাদের কাজ চলে গেছে, পরিবারের উপার্জন নেই, অর্ধেক বেতন পাচ্ছেন, কোনো বেতন পাচ্ছেন না, বাসায় খাবার নেই, বাসা ভাড়া দিতে পারেন না, কাজ চলে যাওয়ার ঝুঁকি আছে. উপার্জনের বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে না, চিকিৎসা নিতে পারছেন না, তাঁরা বৈষম্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হচ্ছেন। কিছু পরিবারে নারী হচ্ছেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এ রকম অনেক নারীর উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাসাবাড়িতে কাজ করতেন যেসব নারী, তাঁরা সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধের কারণে বাসায় ঢুকতে পারেননি।

আরও সহিংসতা

করোনার সংক্রমণ অনেকের মনে আতঙ্ক ছড়ায়। কাজ চলে যাওয়ায়, উপার্জন কমে যাওয়ায়, করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় অনেকেই মানসিক চাপে পড়েন। এর প্রভাব পড়ে মানুষের আচরণে। অনেকে মনে করেন, করোনা মহামারির সময় নারীর সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে এসব বিষয় কাজ করেছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় করোনার প্রথম বছর দেশে ধর্ষণ, পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুকের ঘটনা এমনকি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনাও বেশি ঘটে। ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ১ হাজার ৪১৩টি, ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬২৭টিতে। ২০১৯ সালে ২১৮ জন নারী তাঁদের স্বামীর হাতে খুন হয়েছিলেন। পরের বছর সেই সংখ্যা ছিল ২৪০। সার্বিকভাবে ২০১৯ সালে ৪২৩টি পারিবারিক নির্যাতনের তথ্য পেয়েছিল আসক। ২০২০ সালে ওই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৪।

বাল্যবিবাহ বেড়েছে

দেশে বাল্যবিবাহ থেমে নেই। একাধিক গণমাধ্যম বলেছে, মহামারির সময় সারা দেশে বাল্যবিবাহ অনেক বেড়েছে। বিয়ের পাশাপাশি যৌতুকের ঘটনাও বেড়েছে। ২০১৯ সালে ১৬৭টি যৌতুকের ঘটনা জানতে পারে আসক। আর পরের বছর জানতে পারে ২১৮টি ঘটনার কথা। মহামারির সময় গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে। এ সময় ৪৫টি ঘটনায় গৃহকর্মী নির্যাতনের কথা জানতে পারে আসক। এর আগের বছর সংখ্যাটি ছিল ৩৪।

একই পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী

নারীর ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। ২ মার্চ যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট নারীর ওপর মহামারির প্রভাব নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। তাতে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশসহ ১৯৩টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ওই গবেষণায় দেখা যায়, ওই সব দেশে ২৬ শতাংশ নারী কাজ হারিয়েছেন, পুরুষের ক্ষেত্রে সেই হার ২০ দশমিক ৪ শতাংশ। স্কুল বন্ধ থাকা ছাড়াও অন্য কারনে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার ছাত্রদের চেয়ে বেশি। এ সময় নারীদের প্রতি সহিংসতা পুরুষের প্রতি সহিংসতার চেয়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি দেখা গেছে। মহামারির সময় অন্যকে সেবা করার জন্য পুরুষের তুলনায় নারী বেশি কাজ ছেড়েছেন। এই বৈষম্যের ঘটনা আছে গবেষণার ক্ষেত্রেও।

ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল কোভিড-১৯ বিষয়ক ৬৩ হাজার ২৫৯টি গবেষণা প্রবন্ধ পর্যালোচনা করে দেখেছে, প্রবন্ধকারদের নামের তালিকায় নারীদের অবস্থান নিচের দিকে। অর্থাৎ সেখানে নারীর প্রতিনিধিত্ব যথাযথ নয়।

ল্যানসেট-এর ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে টিকা গ্রহণের ব্যাপারে দ্বিধা ছিল, তবে তা খুব বেশি পরিমানে নয়। চিকিৎসা না পাওয়া এবং চিকিৎসা সামগ্রী না পাওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের নারীদের কাজ হারানোর কথাও ওই গবেষণায় আছে। মহামারির সময় নারীর বিষয়গুলো বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক কর্মকাণ্ডে আলাদা গুরুত্ব না পাওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল। ১১৫টি দেশের কোভিড-১৯ বিষয়ক কমিটি বা টাস্কফোর্সের তথ্য পর্যালোচনা করে এই সাময়িকী জানায়, ৮৫ শতাংশ দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কমিটিতে নারী সংখ্যালঘু। এই বৈষম্যের ঘটনা আছে গবেষণার ক্ষেত্রেও। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল কোভিড-১৯ বিষয়ক ৬৩ হাজার ২৫৯টি গবেষণা প্রবন্ধ পর্যালোচনা করে দেখেছে, প্রবন্ধকারদের নামের তালিকায় নারীদের অবস্থান নিচের দিকে। অর্থাৎ সেখানে নারীর প্রতিনিধিত্ব যথাযথ নয়। তবে এ সময় নারীর প্রতি সহিংসতা কোন পর্যায় পৌঁছেছে তা তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ব্রিংহাম অ্যান্ড উইমেনস হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ও গবেষকেরা। ২০২০ সালে সঙ্গীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৬ নারী হাসপাতালে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালে একই অবস্থার শিকার হওয়া চিকিৎসা নিতে আসা ৪০ নারীর সঙ্গে ওই ২৬ জনের অবস্থার তুলনা করে দেখার চেষ্টা করেন গবেষকেরা। গবেষকেরা দেখেছেন, আগের তিন বছরে নারীদের শরীরে গভীর ক্ষত ছিল ১৬টি। করোনার এক বছরে গভীর ক্ষত বেড়ে হয়েছে ২৮টি।

কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যে এটি ছায়া মহামারি বাড়ছে এবং এটি বন্ধ করার জন্য আমাদের একটি বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা দূরীকরণে বিনিয়োগ করা হল স্মার্ট অর্থনীতি। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের অন্যতম প্রধান বাধা, এর অর্থনৈতিক ক্ষতি আরোও অনেক বেশি।


আরো দেখুন

রচনা : অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব
রচনা : জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ
রচনা : চতুর্থ শিল্পবিপ্লব
রচনা : গিগ ইকোনমি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top