মানসিক সমস্যা জাতির জন্য এক অশনিসংকেত মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান -নজরুল ইসলাম।এ মানুষই পৃথিবীকে করেছে সুন্দর, সুশোভিত ও বাসযোগ্য। নানা অসাধ্যকে করেছে সাধ্য, যোগাযোগ স্থাপন করেছে সূদুর…
মানসিক সমস্যা জাতির জন্য এক অশনিসংকেত
মানসিক সমস্যা জাতির জন্য এক অশনিসংকেত
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান -নজরুল ইসলাম।
এ মানুষই পৃথিবীকে করেছে সুন্দর, সুশোভিত ও বাসযোগ্য।
নানা অসাধ্যকে করেছে সাধ্য, যোগাযোগ স্থাপন করেছে সূদুর আকাশে,পাড়ি জমিয়েছে চন্দ্রে।
এসব তখনই সম্ভব হয়েছে, যখন মানুষের মন ছিল সুস্থ ও প্রস্ফুটিত।
একটি মানুষকে পরিচালিত করে তার মন।মন হলো বুদ্ধি এবং বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপ যা চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা
এবং কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
মন স্বাস্থ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অন্যান্য অঙ্গের মতো মনও অসুস্থ হতে পারে,
যথা সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সেই অসুস্থতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালের গবেষণা অনুযায়ী,
বাংলাদেশে ১৮.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। ৯২ শতাংশ মানুষই কোন ধরনের সেবা বা পরামর্শ নেন না।
মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ মূল ধারার চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর এই ৮ শতাংশের সবাই সরাসরি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন এমন না,
বরং এই অধিক্ষেত্রের চিকিৎসকের অভাবে অন্যান্য চিকিৎসকগণ তাদের সেবা দিচ্ছেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেশে ১৮ কোটি মানুষের জন্য এই মুহূর্তে ২৭০ জন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন।
আর কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র ২৫০ জন, যা অপ্রতুল।
এক বছরে মাত্র ৭ থেকে ১০ জন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রস্তুত হচ্ছেন বলে জানা যায়।
বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে মাত্র দুটি; ২০০ শয্যার ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট’ এবং ৪০০ শয্যার ‘পাবনা মানসিক হাসপাতাল’।
এই অপ্রতুলতার কারণে অনেকেই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সব দিক বিবেচনায় ধারণা করা যায় যে,
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ২.৫ কোটি মানুষ ছোট অথবা বড় মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যায় আক্রান্ত।
আক্রান্ত ব্যক্তি আত্মহত্যা, ট্রমা, উদ্বেগ, মাদক দ্রব্যের ব্যবহার, বিষণ্ণতা, বৌদ্ধিক এবং বিকাশগত অক্ষমতা,
বাইপোলার ডিসঅর্ডার (মানসিক স্বাস্থ্যের একটি অবস্থা যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি অস্বাভাবিকভাবে সুখী বা অবিশ্বাস্যরূপে কম সুখী বোধ করে),
সাইকোসিস (মনের অবস্থা যা কোনটি প্রকৃত এবং কোনটি বাস্তব নয় তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকে) সহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভোগেন।
মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ২০১৮ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন’ নামে একটি আইন প্রনয়ন করা হয়।
এতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা, সম্প্রসারণ, উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় সহ মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তির পুনর্বাসন এর কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবতায় এসব দেখা যায় না।
শহর থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলায় অবস্থিত সমাজসেবা অধিদপ্তরের দফতর গুলোও যেন শুধুই ইট-পাথরের দেয়াল ছাড়া আর কিছুই না।
বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর খুন ও যুদ্ধে নিহতের মোট সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায় আত্মহত্যাসহ অন্যান্য মানসিক ব্যাধির ফলে ঘটা মৃত্যুর সংখ্যা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যায় প্রাণ হারান অর্থ্যাৎ এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই শুধু দেশের অবকাঠামোগত সমস্যাকে
দোষারোপ না করে আমাদের ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
মানসিক সমস্যার চিকিৎসা নিতে যে চিন্তা-ভাবনা গুলো বাধা দেয় তা দূর করতে হবে; সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার যেমন,
কারো মানসিক সমস্যা আছে এটা প্রকাশ পেলে অন্যদের কাছে হেয় হবে বলে মনে করে।
শুধুমাত্র এই চিন্তা করেই সমস্যা দেখা দেয়ার প্রথম দিকে না গিয়ে বরং একেবারে শেষ মুহূর্তে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
অনেক ক্ষেত্রেই এই অবস্থা থেকে রোগীকে পুরোপুরী সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়ে উঠে না।
কেউ কেউ আবার প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি ছেড়ে কবিরাজের ঝাড়-ফুঁকের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে রোগীকে আরো অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেন।
মানসিক অসুস্থতা ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়। প্রত্যেকে ভুল করে, জীবনে অসুবিধা ও ব্যর্থতা থাকে। ব্যর্থতা দুর্দান্ত জীবন গঠনের একটি অঙ্গ।
জীবনে ব্যর্থতা কিংবা ভুল কিছু হয়েছে বলে নিজেকে ধিক্কার দেওয়া যাবে না।
এই পৃথিবীর কোন কিছুই নিজের চিন্তাভাবনার মতো অত্যাচার করতে পারে না।
তাই নিজেকে একটি বিরত দিতে হবে। নিজের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে না বরং নিজের চিন্তা যাতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
বুদ্ধের কথা অনুযায়ী- ‘অতীত যতই কঠিন হোক না কেন, নিজকে সর্বদা আবার শুরু করতে পারেন’।
যেই অবস্থানেই হোক না কেন নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে না দিয়ে লড়াই করে যেতে হবে। যতদিন লড়াই চালানো সম্ভব ততদিন চালিয়ে যেতে হবে, ব্যর্থ হওয়া যাবে না।
যে জিনিসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বা করা যায় না বা পরিবর্তন করা দুঃসাধ্য সে সম্পর্কে নিজেকে চাপ দেওয়া যাবে না।
নিজের জীবনের সমস্ত দাগগুলি ‘পূর্ববর্তী নূন্যতম অর্জন’ দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করতে হবে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রধান সম্পদ এই সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীসহ সমস্ত নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে টেলি-স্বাস্থ্যসেবার
ব্যাপক প্রয়োগ সহ মানসিক চিকিৎসাখাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিৎ এবং সর্বোপরি,
নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেকে-পরিবারকে-এলাকাবাসীকে এই সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
এতেই আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে তৃতীয় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে।
লেখকঃএম.রনি ইসলাম
শিক্ষার্থীঃভূমি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সারা বাংলার সকল আপডেট খবর পেতে যুক্ত হোন আমাদের সাথে