রচনা : চতুর্থ শিল্পবিপ্লব

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব


“The Fourth Industrial Revolution, finally, will change not only what we do but also who we are. It will affect our identity and all the issues associated with it: our sense of privacy, our notions of ownership, our consumption patterns, the time we devote to work and leisure, and how we develop our careers, cultivate our skills, meet people, and nurture relationships.”

– Klaus Schwab (Book: The Fourth Industrial Revolution)

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব : ডিজিটাল বিপ্লব :

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের জনক বলা হয় ক্লাউস সোয়াব (Klaus Schwab) কে। তিনি ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের চেয়ারম্যান। তার লেখা দ্যা ফোর্থ ইনডাস্ট্রিয়াল রেভোলেশন নামক বইয়ে তিনি বিষয়টি বিস্তর আলোচনা করেছেন। আগেকার বিপ্লবগুলোর মূলকেন্দ্র ছিল কৃষিপ্রাণী, শক্তি, রাজনৈতিক কারণ, ভূগোলিক পরিবর্তন ইত্যাদি। কিন্তু ৪র্থ শিল্পবিপ্লব অনেকাংশেই ভিন্ন। ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের মূল নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে প্রযুক্তি এবং এর ব্যবহার, দক্ষতা, চিন্তাশক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

চার শিল্পবিপ্লব :

প্রথম : ১৭৮৪ সাল, বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার
দ্বিতীয় : ১৮৭০ সাল, বিদ্যুতের আবিষ্কার
তৃতীয় : ১৯৬৯ সাল, ইন্টারনেটের আবিষ্কার
চতুর্থ : ডিজিটাল বিপ্লব

প্রথম শিল্পবিপ্লব :

মূল প্রভাবক: বাষ্পীয় ইঞ্জিন
ফলাফল: উৎপাদন শিল্পের সম্প্রসারণ

দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব :

মূল প্রভাবক: বিদ্যুতের উদ্ভাবন ও ব্যবহার
ফলাফল: উৎপাদন শিল্পের আমূল পরিবর্তন

তৃতীয় শিল্পবিপ্লব:

মূল প্রভাবক: কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি
ফলাফল: বিভিন্ন শিল্পে অভাবনীয় পরিবর্তন

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ইতিবাচক প্রভাব :

১। প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি আসছে। যেগুলো আগে বাজারে এসেছে সেগুলোও উন্নত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে।

২। জ্ঞানাঅর্জন ও জ্ঞান দানের সিস্টেমটাই পাল্টে দিচ্ছে। জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি দক্ষতা অর্জনও সমান গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশ্বময় পরিবর্তন হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক। গুরুত্ব পাচ্ছে নতুন উদ্ভাবন । পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে বাস্তবজ্ঞান ও দক্ষতার চাহিদা সব ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩। বিপ্লবের প্রভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বেড়েছে। অনলাইন মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

৪। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখন দোকান বুকিং, অগ্রিম টাকা প্রদান ভাড়া ইত্যাদি পুরাতন পদ্ধতি। বাজার ব্যবস্থা এখন অনলাইন মাধ্যমেই হয়। বাংলাদেশ থেকে ২০১৭ সালেই কর্মাসমার্কেটগুলো বিজ্ঞাপন থেকে আয় করেছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা । ১,৩৩,৫৭১টি অনলাইন ভিত্তিক ওয়েবসাইট থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আয় পৌঁছাতে পারে ৭০ বিলিয়নবা ৭ হাজার কোটি টাকায় ।

৫। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব পড়েছে মেডিকেল সাইন্স সেক্টরে। কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে জটিল রোগের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে। যা এই শিল্প-বিপ্লবেরই প্রভাব ।

৬। কৃষিক্ষেত্রেও রয়েছে এর প্রভাব। গবেষকরা চেষ্টা চালাচ্ছেন বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করার। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান অনেকটাই সফল। নতুন নতুন কৃষিজবীজ উদ্ভাবন, প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ। Robotic sprayers মতো প্রযুক্তি, এখন কৃষি ক্ষেত্রে নিয়মিতই ব্যবহার হচ্ছে।

৭। জিন-প্রযুক্তি, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লকচেইন ছাড়াও অলনাইন মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ের কাজগুলো চতুর্থ শিল্পবিল্পবেরই ফসল। ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের World Development Report-এ বর্তমানে ডিজিটাল দুনিয়ার কিছু চমকপ্রদ তথ্য দেয়া হয়েছে। যেমন-

ক. ইউটিউব দেখা হয় দৈনিক ৮৮০ কোটি বার,
              খ. ই-মেইল পাঠানো হয় দৈনিক ২০ হাজার ৭০০ কোটি,
  গ. আর গুগল সার্চের সংখ্যা দৈনিক ৪২০ কোটি।

৪র্থ শিল্পবিপ্লবের নেতিবাচক প্রভাব:

মানুষের অলসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শারীরিক ও মানসিক শক্তি ভোঁতা করে দিচ্ছে। এখন তো আমরা সাধারণ যোগ-বিয়োগ করতেই মোবাইলের ক্যালকুলেটার ব্যবহার করি । ভার্চুয়াল জগৎ গ্রাস করছে আমাদের। এসব ভার্চুয়াল কর্মকাণ্ড নেতিবাচক প্রভাব তো রাখছেই। প্রযুক্তির কল্যাণে প্রায়শই প্রকাশ হচ্ছে আপত্তিকর তথ্য যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই প্রভাবই আছে। সাইবার ঝুঁকি ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের অংশ। আগামী দিনে আরও হুমকির মুখোমুখি হবে। এ সেক্টরে যেমন চাকরি তৈরি হবে তেমনি নিরাপত্তা ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাবে। বায়ো-টেকনোলজি, প্রোগ্রামিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স ধ্বংসাত্বক ও অনৈতিক কাজে ব্যবহার বাড়বে এবং হচ্ছেও তাই। জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন সমস্যাকেও বলা হয় বিশ্বময় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব। এসব সমস্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।

রচনা : চতুর্থ শিল্পবিপ্লব

চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের আলোচিত প্রযুক্তি:
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং
  • উন্নত মানের রোবোটিক্স ও অটোমেশন
  • ইন্টারনেট অফ থিংস
  • ব্লকচেইন প্রযুক্তি
  • থ্রিডি প্রিন্টিং
  • কোয়ান্টাম কম্পিউটিং
  • উন্নত মানের জিন প্রযুক্তি
  • নতুন ধরনের প্রযুক্তি
চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ:

১। তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ
২। প্রযুক্তিগত সমস্যায় উৎপাদনে ব্যাঘাত
৩। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা
৪। ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তির মধ্যে অব্যাহত সংযোগ নিশ্চিত
৫। অটোমেশনের কারণে বহু মানুষের কাজের সুযোগ হ্রাস

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাঃ

১। অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস
২। উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি
৩। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বড় পরিবর্তন
৪। বিশেষায়িত পেশার চাহিদা বৃদ্ধি
৫। সামগ্রিক জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন

বাংলাদেশে ৪র্থ শিল্পবিপ্লব:

ভৌগলিক কিংবা অর্থনৈতিক কারণে অন্যান্য বিপ্লবগুলোর মতোই বাংলাদেশে উন্নয়নের ছোঁয়া দেরিতে পৌঁছায়। সে হিসেবে ৪র্থ বিপ্লবের ধাক্কা বাংলাদেশে পুরোপুরি পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগবে। ৪র্থ শিল্পবিপ্লব মূলত স্মার্ট কারখানার ধারণাকে সংজ্ঞায়িত করে। সেই হিসেবে দিন ফুরাবে কায়িক শ্রমভিত্তিক বাংলাদেশের। ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের নব নব আবিষ্কারকে স্বাগত জানাচ্ছে জীবনকে আরও গতিশীল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করার জন্য। অন্যদিকে আমরা এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের অনন্য সোনালী সুযোগের মোক্ষম সময়ে। অবস্থান করছি। ২০৩০ সাল যেমন জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আন্তর্জাতিক বছর। আবার সেই সময়টিই আমাদের সর্বোচ্চ কর্মক্ষম মানুষের দেশ (১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সের মানুষ) হওয়ার বছর। এ সুযোগকে আমরা বলি “Golden Opportunity for Bangladesh”। এ সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত Strategic Workforce Plan বা কৌশলগত শ্রমশক্তি পরিকল্পনা যার ছয়টি স্তর হচ্ছে-

১. কৌশলগত দিক-নিদের্শনা প্রদান
২. কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে যোগ্য জনবলের সরবরাহ বিশ্লেষণ
৩. কর্মসংস্থানের চাহিদার বিশ্লেষণ
৪. সরবরাহ ও চাহিদার ব্যবধান বিশ্লেষণ
৫. সমাধান, সূত্রায়ন, প্রয়োজনীয় ইন্টারভেনশন এরিয়া ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণসহ বাস্তবায়ন
৬. বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ

Strategic Workforce Plan এর ছয়টি স্তরের মধ্যে ১ম স্তরটি বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে যা সমন্বিত হয়েছে আমাদের বহুল আলোচিত স্বপ্নভিশন-২০২১ ও ভিশন-২০৪১ এর সাথে। এই দিক নির্দেশনা সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, সংস্থা, শিল্প এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক মিশনসমূহ নির্ধারণ করত টিভিইটি (TVET) এনরোলমেন্ট। ২০২০ সালে ২০%, ২০৩০ সালে ৩০% এবং ২০৪০ সালে অন্তত ৪৫% এ উন্নীত করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার উপযোগী টিভিইটি (TVET) গ্রাজুয়েট তৈরি ও শ্রমবাজারে যুক্ত করার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রযুক্তির মানুষকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। দক্ষতার যথাযথ মূল্যায়ন করে কারগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধি করে সাধারণ শিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার সর্বপ্রকার প্রসার ঘটাতে হবে। ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখনই দেশের চাহিদা ও প্রযুক্তি ভিত্তিক মানব সম্পদ গড়ে তুলতে দেশের সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি বিষয়ক শিক্ষার কোর্স চালু করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা ও আর্থিক খাতকে সাইবার নিরাপত্তা প্রদানের জন্য তৈরি করতে হবে উন্নত সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

দক্ষ ও উপযোগী মানব সম্পদ তৈরি করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে দেশময় কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় দক্ষ মানুষ ছাড়া অন্য কোন উপায়ে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব নয়।

“বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক নিজস্ব কোনো কনটেন্ট তৈরি করেনা, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আলিবাবার নিজস্ব কোনো রিয়েল এস্টেট নেই। এসবই সম্ভব হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তিগত বিপ্লবের কারণে।”

—টম গুডউইন
(সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, হাবাস মিডিয়া)


আরো দেখুন

রচনা : গিগ ইকোনমি
রচনা : পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব
রচনা: সামাজিক জীবনে করোনা ভাইরাসের প্রভাব
রচনা : ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top