রচনা : জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ


“বাংলাদেশ জাতিসংঘের এক মডেল সদস্য”
—বান কি মুন

[table id=10 /]

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলছে। দেশের লাল-সবুজ পতাকা অশান্ত দেশগুলোর মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছে ‘বাংলা বন্ধু দেশের পতাকা হিসাবে। অশান্ত দেশগুলোতে শান্তি ফেরাতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা মিশনে সাফল্যের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাদের সাফল্যের কারণে বাংলাদেশের সম্মান দিন দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে, বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে এক নম্বর স্থানে উঠে এসেছে। বিভিন্ন মিশনে তারা রাস্তা-ঘাটসহ অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করে যাচ্ছে। দক্ষিণ সুদানে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের তৈরি একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ রোড’। অন্যদিকে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দিক থেকেও দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছেন।

বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মহান ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতিসংঘ। পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা মানব সমাজকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করে। এই অনুপ্রেরণা থেকেই উদ্ভব হয় জাতিসংঘের । জাতিসংঘের ৬টি মূল অঙ্গ সংস্থা এবং অনেকগুলি সহযোগী সংস্থা বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে শান্তি স্থাপনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের এই কার্যক্রমের এক গর্বিত অংশীদার।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন:

বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা জাতিসংঘের প্রধান কাজ। এক দেশের সাথে অন্য দেশের বিরোধ নিরসন ও মধ্যস্থতায় জতিসংঘ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং জাতিগত দাঙ্গা মোকাবিলায় এরূপ পদ্ধতি পুরোপুরি কার্যকরী নয়। সেখানে নিরাপত্তার প্রশ্নে সামরিক শক্তি প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন গঠিত হয়েছে।

মিশনের পরিচিতি:

জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। সদস্য দেশগুলোর প্রেরিত সামরিক সদস্যরাই এর প্রধান শক্তি। নিরাপত্তা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন দেশের সামরিক, বেসামরিক ও আধা-সামরিক লোকজন নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে (ইসরাইল-ফিলিস্তিন) কেন্দ্র করে প্রথম শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়। এর পর থেকে যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সেখানেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ করেছে। অভাবক্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর নিকট ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে সহায়তা করা এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশের পুনর্গঠনে শান্তিরক্ষী বাহিনী জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে জাতিসংঘ এ পর্যন্ত ৬৫ টি মিশন পরিচালনা করেছে এবং এর মধ্যে চলমান আছে ১৫টি মিশন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী ১৯৮৮ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে।

শান্তিরক্ষী মিশনের কাজ:

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন যে কাজ করে তার মধ্যে প্রধান হলো- বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি তদারকি ও কার্যকর করা, স্থিতাবস্থা বজায় রাখা ও গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচন পরিচালনা করা, বিবাদমান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সমঝোতা ও চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি করানো, ভূমি আইন অপসারণ করা, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো পুনর্গঠনে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের মানবিক সাহায্য প্রদান ইত্যাদি।

  • নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
  • সামরিক পর্যবেক্ষক
  • মাইন উদ্ধার
  • আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা
  • নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা করা।
  • মানবিক সহায়তা প্রদান
  • অবকাঠামো উন্নয়ন
শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ :

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ

শান্তিরক্ষা মিশন ও বাংলাদেশ :

জাতিসংঘের বিশ্বশান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ বরাবরই সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। শান্তিরক্ষা মিশনে জাতিসংঘের আহবানে বাংলাদেশ প্রথম অংশগ্রহণ করে ১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে। সে যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল প্রশংসাযোগ্য। এর পর দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে (২০১৩ সাল পর্যন্ত) বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী যেমন- সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ প্রভৃতি কৃতিত্বের সাথে এই মহতী দায়িত্ব পালন করে আসছে। বাংলাদেশি এসব বাহিনী দৃঢ় মনোবল, উন্নত শৃঙ্খলা, কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ১৫টি মিশনের মধ্যে ১২টিতে কাজ করছে। সব মিলে ৫৪টি মিশনে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী অংশগ্রহণ করেছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন দেশের অবস্থান :

[table id=9 /]

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সামরিক ও পুলিশ সদস্য পাঠানো দেশগুলোর মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের ৬ হাজার ৪৭৭ জন পুরুষ ও ২৫৫ জন নারী মিলিয়ে মোট ৬ হাজার ৭৩২ জন শান্তিরক্ষী জাতিসংঘ মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইথিওপিয়া, এ দেশটির শান্তিরক্ষীর সংখ্যা ৬ হাজার ৬৬২ জন। রুয়ান্ডার রয়েছে ৬ হাজার ৩২২ জন। নেপাল ৫ হাজার ৬৮২ জন নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে নেপাল, ৫ হাজার ৩৫৩ জন নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে ভারত, পাকিস্তান ৪ হাজার ৪৪০ জন নিয়ে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। মিশর ৩ হাজার ৯৩ জন শান্তিরক্ষী নিয়ে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী নানা জাতি-গোষ্ঠী থেকে আসা। ভিন্ন সংস্কৃতি আর ভাষার এসব শান্তিরক্ষীর একমাত্র লক্ষ্য থাকে ঝুঁকিপূর্ণ মানবগোষ্ঠীকে রক্ষা করা। সহিংসতা থেকে শান্তির পথে আসা দেশগুলোকে সহযোগিতা করা। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ অন্যতম বৃহৎ শান্তিরক্ষী জোগানদাতা দেশ। বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী জোগানে এক নম্বর বৃহত্তম দেশ বলে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকা:

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী অংশগ্রহণ করলেও সেনাবাহিনীর ভূমিকাই প্রধান। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মূলমন্ত্র হলো ‘শান্তিতে আমরা, সমরে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবদান দেখলে মনে হয় সারা বিশ্বের সব দেশই যেন বাঙালি সেনাবাহিনীর নিজ দেশ। সকল দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষাই যেন তাদের কাজ। আর তাইতো বাংলাদেশ বর্তমানে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সর্বোচ্চ সংখ্যক সেনা প্রেরণকারী দেশ।

জাতিসংঘের বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উল্লেখ যোগ্য কার্যক্রমসমূহের বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো-

[table id=11 /]

  • নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
  • সামরিক পর্যবেক্ষক
  • মাইন উদ্ধার
  • আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা
  • নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা করা
  • মানবিক সহায়তা প্রদান
  • অবকাঠামো উন্নয়ন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদানের স্বীকৃতি:

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সড়কের নাম রেখেছে বাংলাদেশ স্ট্রীট। এর থেকেও বড় স্বাকৃতি ও প্রাপ্তি হলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশসমূহের সাধারণ মানুষের মুখে ফুটিয়ে তোলা হাসি ও তাদের ভালোবাসা।

বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন যে অবদান রেখে চলছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বিভিন্ন বাহিনীর ভূমিকা এবং সাফল্য আমাদেরকে গর্বিত করেছে। এর মধ্যে আবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকাই মুখ্য। এ পর্যন্ত এই কার্যক্রমে বাংলাদেশের শতাধিক বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। তারপরও বাঙালিদের শৃঙ্খলাবোধ, পেশাদারীত্ব এবং দক্ষতা স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এটি দেশ ও জাতির নিকট অত্যন্ত গৌরবের বিষয় বলে বিবেচিত।


আরো  দেখুন

রচনা : চতুর্থ শিল্পবিপ্লব
রচনা : গিগ ইকোনমি
রচনা : পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব
রচনা: সামাজিক জীবনে করোনা ভাইরাসের প্রভাব

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top