রচনা : শীতের সকাল

শীতের সকাল


সূচনা :

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এই বাংলার রূপ প্রত্যক্ষ করে আবার ফিরে আসতে চেয়েছেন এমনি এক সকালে—

” কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায় “

পূর্ব দিগন্তে আলোর সুষমা পরিপূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই বনে বনে পাখিদের মনে তার গোপন আঁগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়ে সবার অলক্ষ্যে। বনান্তরালে তাদের মধুর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠে দিনারম্ভের কল-মুখরিত আনন্দ রাগিণী। এই প্রত্যাশিত সূর্যমামাকে স্বাগতম জানানোর আবাহন-গীতি। তাদের শিশির-সিক্ত কণ্ঠে লাগে আনন্দের অনবদ্য জোয়ার। কুয়াশা জড়িত বনভূমি প্লাবিত করে তাদের কলমধুর গানের সুর-লহরী ছড়িয়ে পড়ে দিক-দিগন্তে লাগে হাওয়ার নাচন—

"শীতের হাওয়ার লাগল নাচন 
                      আমলকীর এই ডালে ডালে।
পাতাগুলি শিরশিরিয়ে
                     ঝরিয়ে দিল তালে তালে।"

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাংলার শীতের সকাল :

লেপের ওমের মায়াবী আকর্ষণ কেটে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে করে না। শিওরে হিংস্র শীত যেন কেশর ফুলিয়ে, থাবা পেতে বসে আছে। গরম বিছানার স্ব-রচিত উত্তাপ ছেড়ে উঠতে গেলে কেমন এক দুর্নিবার আলস্য সমস্ত চেতনাকে ঘিরে ধরে। তন্দ্রা-বিজড়িত চেতনায় দূর বনান্তরাল থেকে পাখিদের কল-কাকলি শোনা যায়, আর কানে আসে পথচারীদের বাতাসে ভেসে আসা দু-একটি বিচ্ছিন্ন সংলাপ: অথচ চারদিকে পৃথিবী এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় মগ্ন। শীতের সকালে এক নিঃসীম জড়তা সকলের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কর্মের আহ্বান সত্ত্বেও এক সুদূর-ব্যাপ্ত নৈষ্কর্মের জড়তায় মানুষ আরামের শয্যায় পড়ে থাকে আর কল্পনা করতে ভালোবাসে শীতের বুড়ি কুয়াশার কম্বল গায়ে দিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে আমারই প্রতীক্ষায়—

হিম হিম শীত শীত/
               শীতবুড়ি এলো কনকনে ঠাণ্ডায় /
দম বুঝি গেল রে।

কিন্তু শীতের এ বুড়ি বেশিক্ষণ প্রধান্য বিস্তার করতে পারে না। পূর্ব-দিগন্তের কুয়াশর জাল ছিন্ন করে এক গভীর আলস্যে উঠতে থাকে শীতের সূর্য পূর্বাকাশে। তার কিরণ-বাণে পর্যুদস্ত হয় শীতের তীব্রতা। সকালের সোনালি রোদ চারদিকে ভেসে যায়। এই মিষ্টি রোদের স্পর্শে শীতের সকাল যেন একবিন্দু শিশিরের মতো টলতে থাকে।

“সকালে সোনার আলো করে চিক চিক সবুজ ঘাসের শিশির করে ঝিক মিক”

—আবু জাফর ওবাইদুল্লাহ

গ্রামে শীতের সকাল:

গ্রামে-গঞ্জে শীতের সকালে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব দৃশ্য। শীতের সময় শাকসবজি, তরিতরকারি উৎপন্ন হয় বেশি। শীতের সকালে পাওয়া যায় টাটকা খেজুর রস। ভাপা পিঠার মৌ মৌ গন্ধে সকালবেলায় খিদে বেড়ে যায়। শীত একটু বেশি লাগলে সকালবেলায় নাড়ার আগুনে ছেলের দল মটরশুটি পুড়িয়ে খায় আর আগুন পোহায়। মধু সংগ্রহের আশায় শর্ষে ক্ষেতের দিকে যায় মৌমাছিদল—

“সরষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হাওয়ার সুখে
মটর বোনের ঘোমটা খুলে চুম দিয়ে যায় মুখে”

শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ:

শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন রকম পিঠা। তখন গ্রামে প্রচুর খেজুরের রস পাওয়া যায়। এজন্য শীতের খুব সকালে খেজুর গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামানো হয়। শীতের সকালে এ রস খেতে খুবই ভালো লাগে। সকাল হতে না হতেই গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র খেজুর রসের পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। গ্রামের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে রোদ পোহাতে পোহাতে মুড়ি-মুড়কি, পিঠা-পায়েস খেতে পছন্দ করে। এছাড়া হরেক রকম পিঠা ঘরে ঘরে বানানো হয়। তাই কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন—

“পৌষ-পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।”

এই পৌষ শুধু খাবারের রকমারি আয়োজন সাজায় তা কিন্তু নয়। পৌষ বয়ে আনে ফসলের সম্বার। কৃষক সকালে কান্তে হাতে চলে মাঠে ফসল সংগ্রহের জন্য। একটু বেলা বাড়ার সাথে সাথে কৃষাণবালা পরম যত্নে পিঠা-পায়েস গামছায় বেঁধে মাঠে যায় স্বামীর খাবার নিয়ে। কৃষাণ সারাদিন মাঠে ফসল কেটে সন্ধ্যায় ফিরে আসে ফসল নিয়ে। ভরে যায় আঙ্গিনা ও কৃষাণ-কৃষাণীর মন। কবিগুরুর অনুভবে এসছে এভাবে—

পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে/ আয় আয় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে/ মরি হায় হায় হায়।

রচনা : শীতের সকাল

শীতের সকালের চিত্র:

শেষরাতে টিনের চালে টুপটাপ করে কুয়াশাঝরা মায়াবি শব্দ ভেদ করে মোরগের ডাক, পাখির কূজনে শুরু হয় সকালের আগমনী বারতা। ঘর ছেড়ে বেরুলে গাছের ঝরা পাতার চাদরে ঢাকা পথ যেন মনে পত্রপথ। সেই পথে সামান্য এগুলেই চোখে পড়ে বিশাল শর্ষেক্ষেতের ওপারে ঘনসবুজ গাছে যেন প্রকৃতির এক নিরাপদ অর্ধবৃত্ত সৃষ্টি হয়ে আছে। শর্ষেক্ষেত যেন মনে হয় মাটির সমতলে হলুদের মিছিল। চোখের সমান্তরালে, ডানে, বায়ে, সামনে ও পেছনে কুয়াশার বৃত্ত। তখন গুণগুণিয়ে কেবলই গায়তে হচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথের সেই চরণগুলি—

শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এল/ গানের বেলা শেষ না হতে হতে?
মনের কথা ছড়িয়ে এলোমেলো/ ভাসিয়ে দিল শুকনো পাতার স্রোতে।

শীতের সকালের অসুবিধা:

শীতের সকালে হাড় কাঁপুনে শীত পড়লে দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষেরা জড়তা ও বিষণ্নতায় ভোগে। মানুষের কাজের উদ্যম থেমে যায়। আরাম-আয়েস করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করলেও অনেকের পক্ষেয় তা সম্ভব হয় না। গরম কাপড়ের অভাবে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় কাঁপতে থাকে গরিব মানুষ। সুকান্তের ভাষায়—

হে সূর্য, তুমি তো জানো/
                    আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!
সারা রাত খড়কুটো জ্বালিয়ে/
                    এক টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই!

উপসংহার:

হাড় কাঁপানো বা পাতা ঝরানো কিংবা আলস্য বাড়ানো অথবা লোভ জাগানো- শীতের সকাল যেভাবেই ধরা দিক না কেন বিভিন্ন জনের কাছে, সময় দিনের মধ্যে এর শুরুর তাৎপর্য একটু বেশি, তা স্বীকার করতেই হয়। শীত যেমন মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায়, তেমনি জীবনকে উপভোগ্যও করে তোলে। তাই শেষে বলা যায়—

“এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরি জয়, যুগের পরে যুগান্তরে বরণ করে লয়।”

— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আরো দেখুন

রচনা : মেগা প্রজেক্ট
রচনা : মহামারিতে নারীর প্রতি বৈষম্য
রচনা : অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব
রচনা : জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top