সাহিত্যিক পরিচিতি : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দারিদ্রের কারণে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশি লেখাপড়া করতে পারেন নি। চব্বিশ বছর বয়সে মনের ঝোকে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন। সংগীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতির সূত্রে ঘটনাচক্রে এক জমিদারের বন্ধু হয়েছিলেন। জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন বার্মায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনের এসব অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র সব মানুষের চরিত্র ফুঁটিয়ে তুলেছেন তাঁর অজস্র উপন্যাসে। বিশেষ করে সমাজের নিচু তলার মানুষ তাঁর সৃষ্ট চরিত্রে অপূর্ব মানব-মহিমা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।শরৎচন্দ্রের জন্ম ১৮৭৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। তাঁর মৃত্যু ১৯৩৮ সালে কলকাতায়। তাঁর সাহিত্য জীবনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের গল্প ‘মন্দির’ কুন্তলীন পুরস্কার পায় ১৯০৩ সালে। ১৯০৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায়, ‘বড়দিদি’ নামে শরৎচন্দ্রের একটি বড় গল্প প্রকাশিত হলে এর অপূর্বত্বে সাধারণ পাঠক মনে করেছিল, রবীন্দ্রনাথই বোধহয় ছদ্মনামে এ কাহিনী রচনা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও পড়ে দেখলেন, এ গল্প যিনি লিখে থাকুন, তিনি একজন অসাধারণ শিল্পী। ক্রমে ক্রমে অপরিচয়ের মেঘ কেটে গেল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছদ্মনামের আড়াল থেকে স্নিগ্ধ আলোক নিয়ে রবির পাশেই উদিত হলেন উপন্যাস-গল্পে। সেই জীবনকে অবলম্বন করে তিনি নতুন সাহিত্যরস ও শিল্পদর্শন সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর চরিত্র ও শিল্প জীবন বড় বিচিত্র। কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে বিচরণ করেও তিনি নিজের চারদিকে একটা অদৃশ্য যবনিকা টেনে দিয়েছিলেন।

শরৎচন্দ্রের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ‘বড়দিদি’ ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর তিরিশখানি উপন্যাস ও গল্পসংকলন পাঠক সমাজে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছিলো। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘শুভদা’ (১৯৩৮) এবং ‘শেষের পরিচয়’ (১৯৩৯)। শেষোক্তটি অসম্পূর্ণ রেখেই তাঁর মৃত্যু হয়। এর অবশিষ্ট অংশ রচনা করে শ্রীমতী রাধারানী দেবী। এছাড়াও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই তাঁর কয়েকখানি উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। (ষোড়শী-১৯২৮, রমা-১৯২৮, বিরাজবৌ ১৯৩৪, বিজয়া-১৯৩৫)। তাঁর দু’খানি প্রবন্ধ গ্রন্থ (নারীর মূল্য-১৩৩০, এটি তাঁর দিদি অনিলা দেবীর নামে প্রকাশিত হয়, তরুণের বিদ্রোহ-১৯১৯, স্বদেশ ও সাহিত্য-১৯৩২) এবং কয়টি বক্তৃতাও (শরৎচন্দ্র ও ছাত্রসমাজ) ছাপা হয়েছিল। তাঁর কিছু কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তিরিশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এতগুলো শ্রেষ্ঠ ও বিচিত্র গ্রন্থ রচনা করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অদ্ভূত মানসিক ‘দমের’ পরিচয় দিয়েছেন। তাতে কোন সন্দেহ নেই।

‘শ্রীকান্ত’ শরৎচন্দ্রের সর্বাধিক জনপ্রিয় আত্মজৈবনিক রচনা। কেউ কেউ একে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলেছেন। এর ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি শরৎচন্দ্রের অপরূপ সৃষ্টি। শ্রীকান্তের সঙ্গে তার যখন পরিচয় হল, তখন সে শৈশব অতিক্রম করে কৈশোরে পদার্পণ করেছে। ইন্দ্রনাথের যে বৈশিষ্ট্যটি সর্বপ্রথম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে এই যে, সে একজন সত্যিকার মহামানব। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সে পড়েছে, খেলার মাঠে মারামারি, গঙ্গার উজান বয়ে মাছ চুরি, জেলেদের সতর্কতার মধ্যে দিয়েও মাছ নিয়ে পলায়ন, সাপ, বুনো শুকর ইত্যাদি তার অভ্যস্ত জীবনযাত্রার অঙ্গ। ইন্দ্রনাথের সাহসই তার চরিত্রের প্রধান গুণ।

শরৎচন্দ্র এঁকেছেন মানব মনের সংঘাত ও দ্বন্দের ছবি। বর্তমান যুগের সাহিত্যের উপজীব্য হচ্ছে সমাজের প্রভাব। কিন্তু শরৎ সাহিত্যের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, এখানে সমাজের শক্তির প্রভাবও দেখা যায় বাইরের শক্তি হিসেবে নয়, তাও তার মনের মধ্যেই নীড় বেঁধেছে। মানব হৃদয়ের প্রণয়াকাঙ্ক্ষা তার নিজস্ব সম্পদ আর ধর্মবুদ্ধির মূলে রয়েছে সংস্কার। নারীর চিত্তে এই দুটি শক্তির মধ্যে নিরন্তর যে দ্বন্দু চলছে শরৎচন্দ্র তাকেই রূপ দিয়েছেন। বিরাজ বৌ, দেবদাস, দত্তা, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেনাপাওনা প্রভৃতি উপন্যাসের নায়িকারা তারই প্রমাণ।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমাজ সংসার প্রভৃতি সংস্কার ও বন্ধনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন না। তাঁর এই বন্ধন অসহিষ্ণু ‘বোহেমিয়ান’ জীবনযাত্রা সে যুগে নীতিবাগীশদের ততটা মনঃপূত ছিল না। এ ধরনের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয় ছিল বলে শরৎচন্দ্র সাহিত্য সৃষ্টিতে ক্ষণিকতার জয়গান গেয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন যে, সাহিত্যে নিত্যবস্তু বলে কোন পদার্থ নেই। তিনি সাহিত্যকে প্রশস্ত, বন্ধনমুক্ত করতে চেয়েছেন, রসতত্ত্ব বিচারে এটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। কোনো আদর্শের খাতিরেই তিনি সাহিত্যের দাবিকে খাটো করতে চাননি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “সাহিত্যের নানা কাজের মধ্যে একটা কাজ হইতেছে জাতিকে গঠন করা, সকল দিক দিয়া তাহাকে উন্নত করা।”

সাহিত্য বিচারে তিনি চিন্তার বিস্তৃতি ও মনের ঔদার্যের যে পরিচয় দিয়েছেন তাঁর তুলনা বিরল, শুধু রস সৃষ্টিতে নয়, রস-বিচারেও তিনি অনন্য সাধারণ। শরৎ সাহিত্যে মানুষের বেদনার ছবি যেভাবে ফুটেছে সমগ্র বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাঙালির চরিত্রের স্বাভাবিকতা যত দিন থাকবে, শরৎচন্দ্র ও ততদিন পাঠকের হৃদয়রাজ্যে আধিপত্য করবেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক। সরকারি-বেসরকারী, বিসিএস, ব্যাংকসহ সব ধরনের চাকুরী ও পরীক্ষার জন্যে রচিত।


আরো দেখুন

Composition : Global Warming
Composition : Gender Discrimination in Bangladesh
Composition : Price Hike
Composition : If I were the Home Minister of Bangladesh

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top