সামাজিক জীবনে করোনা ভাইরাসের প্রভাব
সামাজিক জীবনে করোনা ভাইরাসের প্রভাব তবে নিয়মানুযায়ী, এই পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। একদিন হয়ত সংশয়, নিস্তব্ধতা কেটে যাবে। এটাই সত্য যে, ‘রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকটে আসে।’ এই প্রবাদটি কিছুটা হলেও আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবে।
হ্যাঁ, পৃথিবী থেকে করোনা একদিন থেমে যাবে। তবে মানুষকে ভুলতে দেবে না এর প্রভাব রেখে যাবে অনেক ভয়ানক চিহ্ন। এখন সবচেয়ে বড় উপলব্ধির বিষয় হচ্ছে- কেমন হতে পারে করোনা পরবর্তী পৃথিবী? কী কী পরিবর্তন আসতে পারে আমাদের সামগ্রিক জীবনাচরণে? কিংবা করোনাত্তোর পরিস্থিতিতে সামাজিক সম্পর্ক, সমাজ কাঠামো ও সামাজিকীকরণের নতুন বিন্যাস কেমন হবে? দেখা যাক, এসব জিজ্ঞাসার প্রতিউত্তরে কি পাওয়া যায়?
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষে মানুষে যে কাছে আসা কাঙ্ক্ষিত, করোনাকালে দেখছি সেই কাছে আসা নিয়েই ভয়! কারণ, করোনা মানুষ থেকে মানুষেই সংক্রমিত হয়। ফলে পরস্পরের শারীরিক দূরত্ব জরুরি। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে সঙ্গত কারণেই সকলকে সামাজিক বা শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। এ থেকে পরস্পরকে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস গড়ে গড়ে তুলতে হচ্ছে। ফলস্বরুপ, সামাজিক জীবনযাপনের নতুন অনুষঙ্গ হতে যাচ্ছে সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা’। এ থেকে আমাদের মনের ভেতরে গেঁথে গেছে এক অজানা আতংক। আগামীতে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, সভা-সমাবেশ, শপিংমলে যাওয়া এমনকি গণপরিবহনে চড়াও কমিয়ে দেবেন অনেকেই।
বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন অটুট ও দৃঢ় হতে কিছু সামাজিক মিথস্ক্রিয়া মাধ্যম হিসেবে কাজ করতো। এখন ভাবার বিষয় যে, হাত মেলানো, কোলাকুলি, ঘাড়ে হাত দেয়াসহ কিছু সামাজিক ঘনিষ্ঠতার আচরণগুলো কি পরিবর্তিত হবে? নাকি সম্পর্ক দৃঢ় করতে অন্য মাধ্যম অবলম্বন করতে হবে? যেখানে একে অপরকে দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হচ্ছে।
অন্যদিকে সামাজিক এ মিথস্ক্রিয়াগুলো সত্যিই যদি অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে এগুলোর বিকল্প কী হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। অনেকেই ঝুঁকি নিয়েই নিয়মিত অফিস করছে। অফিসে কাজের সময় সহকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই একে অন্যের কাছে আসে। তাদের অনেকেই হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। তখন মানুষ দ্বিধা-দ্বন্ধে পড়ে যায়। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। কারণ করোনাই আমাদের মধ্যে এই সংশয় তৈরি করছে। মূলত বেঁচে থাকার স্বার্থে হ্যান্ডশ্যাক পরিহার করতে হচ্ছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণঃ
ক. অমর্ত্য সেনের ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণার দেখা গেছে যে দুর্ভিক্ষ বছরে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়নি। প্রকৃতপক্ষে, লোকেরা খাবার ক্রয় বা অতিরিক্ত ক্রয়ের ক্ষমতাটি অভাব ছিল। জাতিসংঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতোমধ্যে দুর্ভিক্ষের আভাস দিয়েছে, ফলে সামাজিক অস্থিরতা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাবে।
খ. বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাঙালি দেশে ফিরে এসেছে, আরো আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়তি চাপ বেকারত্ব যেমন- বাড়িয়ে দেবে তেমনি চুরি, ছিনতাই, সন্ত্রাসের মত অপরাধমূলক কর্মকান্ড অনেক বেড়ে যাবে।
গ. অক্সফার্মের গবেষণায় দেখা গেছে যে করোনা কালীন সময়ে বাংলাদেশে দারিদ্রের হার ২০% থেকে ৩৪% পৌঁছেছে। করোনা দুর্যোগের আগে যে পরিবারগুলোর আয় জাতীয় দারিদ্র্যসীমার বেশ উপরে ছিল, তাদের ৮০% এর বেশি বর্তমানে দারিদ্র্যেসীমার নিচে নেমে এসেছে। ফলে অনেক পরিবারই অসহায় হয়ে পড়েছে, সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে সামাজিক ভাঙন ঘটবে।
ঘ. করোনা উত্তর বিশ্বজুড়ে সামাজিকতা ও সম্পর্কের নতুন বিন্যাস এবং অনলাইন নির্ভরতাও অনেক বেশি বাড়বে। বিরূপ প্রভাব পড়বে পর্যটনে।
ঙ. মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইত্যাদি নানামুখী চাপ থেকে মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, সহিংসতা, রক্ষণশীল রাজনীতি ইত্যাদি আরও বাড়তে পারে।
সামাজিক জীবনে করোনা ভাইরাসের প্রভাব
সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় খুলে দেয়া হল, ক্লাস শুরু হল। সহপাঠীদের কারো একজনের করোনার লক্ষণ দেখা দিলে ক্লাসের সবাই আতংকিত হবে। আর পজিটিভ হলে তো সবাইকেই বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। এতে করে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাঘাত ঘটবে। শুধু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়। শিশুদের মানসিক বিকাশ ও সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বর্তমানে করোনা রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। স্কুল বন্ধ থাকায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা নেই, খেলা নেই, ঘরের চার দেয়াল ছাড়া কোথাও বেড়াতে যাওয়ার উপায় নেই। যা শিশুর মনোজগতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। শিশুদের প্রতি বাবা-মায়ের মানসিক চাপ বাড়বে। এতে বাবা- মায়ের ওপরও শিশুদের ক্ষোভ তৈরি হতে পারে, সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনও বেড়ে যেতে পারে। আর দরিদ্র পরিবারের শিশুরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সংস্পর্শে আসতে পারে। সবমিলিয়ে ক্ষুধা, অপুষ্টি, শিশু শ্রমের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের মনে নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘমেয়াদি একটা ট্রমা রেখে যাবে করোনা ভাইরাস সৃষ্ট মহামারি।
একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যেখানে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ বাস করে, সেখানে সমাজ জীবনে মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব যেন একটু বেশিই পড়ে। ফলে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের ঘটনা ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে। করোনা রোগীর প্রতি সামাজিক অবহেলা, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীদের বাসা থেকে উচ্ছেদ, খাদ্য মজুদ, নকল করোনা রিপোর্ট, পিপিই চুরিসহ অসংখ্য নৈতিক অবক্ষয়ের ঘটনা ঘটেছে। একথা অস্বীকার করা উপায় নেই করোনা একটি স্বার্থপর সমাজের জন্ম দিচ্ছে।
এছাড়াও নতুন প্রজন্মের একটা অংশ বাস্তব জীবন থেকে ভার্চুয়াল জগতের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্মে অনলাইন নির্ভরতা বাড়ছে। শুধু করোনা ভাইরাসই এক ধাক্কায় এতকিছু পরিবর্তন করে দিচ্ছে। কিন্তু ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে বা অনলাইন কেন্দ্রীক প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়ন একটু কঠিন হবে না? সাধারণত পারস্পরিক স্পর্শগত মিথষ্ক্রিয়তায় ভাব প্রকাশের পরিবর্তে মৌখিক যোগাযোগে তা পরিণত হবে। পিঠে, মাথায় বা কাঁধে হাত দিয়ে উৎসাহ দেয়া, স্নেহ করা বা আবেগপূর্ণ পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা দিতে জড়িয়ে ধরা প্রকৃতিগতভাবে সম্পর্ককে আরো মজবুত করে। কিন্তু এর বৈপরীত্যের চাপ স্পষ্ট। সঙ্গরোধ ও সামাজিক দূরত্বের বিধান মানতে গিয়ে মানুষ নানাভাবে আক্রান্ত হবে। প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নীতি, নৈতিকতা ও প্রথায় ফাটল দেখা দিবে। চিন্তা-ভাবনার মধ্যেও চলে আসবে নানা বিভ্রান্তির বেড়াজাল। মানুষের মনস্তাত্ত্বিকতাও বিপন্ন হবে। ফলে সর্বত্র বিরাজমান এক গভীর অসুস্থতার ছাপ সমাজ ও মানুষের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও প্রকাশ পাচ্ছে।
আমাদের দেশে সামাজিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়িত্ব বোধের অভাব রয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে করোনা ভাইরাস প্রভাব। ফলে সামাজিক দূরত্ব আরো বাড়ছে এবং মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, হতাশা, নিঃসঙ্গতা বোধের একধরনের সুপ্ত চাপ বিরাজ করছে। সমাজে মানবিক সংকটের কিছু চিত্র স্পষ্ট দৃশ্যমান হচ্ছে। যেগুলো আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। ত্রাণের চাল চুরি, বাড়িওয়ালা কর্তৃক ভাড়াটিয়া নিগৃহীত, করোনা আক্রান্তদের প্রতি নানা সামাজিক নিগ্রহ ও অসৌজন্যমূলক আচরণ, সন্তান মাকে জঙ্গলে ফেলে যাওয়া, মৃতদের দাফনে বাধা প্রদান, ত্রাণের কথা বলে ধর্ষণসহ যত অমানবিক, অসামাজিক কাজ আছে সবই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তবে এতো কিছুর মধ্যে কিছু বিষয় আশার সঞ্চার করছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই এ মহাবিপর্যয়ে এগিয়ে এসেছে। নাগরিক দায়িত্ববোধ পালনের প্রবণতা ব্যাপকতর হচ্ছে।
এটাই বাস্তবতা যে, করোনাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের জীবনধারণ করতে হবে। করোনা এই পৃথিবীতে কতদিন থাকবে তা অনুধাবন করা খুবই দুষ্কর। ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে জীবনসংগ্রামে এগিয়ে যাওয়াই প্রধান কর্তব্য। পাশাপাশি করোনাকালে সমাজ কাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা ও মানুষের সুরক্ষার জন্যেও সচেষ্ট হতে হবে; যা উপলব্ধি করা সকলের জন্যই জরুরি।
আরো দেখুন
রচনা : ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০
রচনা : বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য
Composition : Good Governance
Composition : Globalization and its Influences on Bangladesh